উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধির কারণে দেশজুড়ে ব্যবসায়িক খরচে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সব ধরনের ব্যবসার ওপর। হালকা ইস্পাতের রড থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স কিংবা খাদ্যপণ্য সব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন ব্যয় কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন ইউটিলিটি ব্যয় হ্রাস, ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং বিকল্প অর্থায়নের পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ পরিচালন ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে সীমিত কর্মী দিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা এবং বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আফসার বলেন, ‘পরিস্থিতি সত্যিই কঠিন।’ তার ভাষ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন কমিয়েছে।
তিনি বলেন, চলমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে দাম বাড়ালে বিক্রি আরও কমে যাওয়ার শঙ্কায় তারা পণ্যের মূল্য স্থির রেখেছেন। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটি খরচ কমানোর কৌশল নিয়েছে।
নুরুল আফসার জানান, ব্যাংকের সুদহার এখন ১৭ শতাংশের বেশি। যেখানে তিন বছর আগেও তা ছিল ১০ শতাংশের নিচে। সেই সময়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮০ টাকা এবং মূল্যস্ফীতি ছিল ছয় থেকে সাত শতাংশ। এখনকার পরিস্থিতিতে উচ্চ সুদের কারণে তাদের মুনাফা অনেকটাই কমে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইউটিলিটি ব্যবহার সীমিত করেছি, অফিসের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কেটে দিয়েছি। যেখানেই অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ আছে সেখানেই ব্যয় হ্রাস করছি।’
এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে একই পথে হাঁটছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড। এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘ব্যাংকের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও অসহনীয়। এমন বাস্তবতায় খরচ কমানো ছাড়া উপায় নেই।’
তিনি বলেন, প্রতিটি খাতে খরচ হ্রাস এবং প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে তারা এ চাপ মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। কর্মীদের বেতন সময়মতো দিতে প্রতিষ্ঠানটি সাশ্রয়ী নীতির দিকে ঝুঁকেছে এবং শুধুমাত্র অপরিহার্য খাতে ব্যয় করছে। পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণার বাজেটও কমিয়ে আনা হয়েছে।
তবে বিনিয়োগে ঋণ নেওয়া অপরিহার্য হলেও ব্যাংকের উচ্চ সুদ হারানো সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তপন সেনগুপ্ত।
এ অবস্থায় ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘টিকে থাকার জন্য ব্যাংক ঋণ ও খরচ কমাতে হয়েছে নতুন কিছু ভাবতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।’
তিনি জানান, প্রাণ-আরএফএল এখন উৎপাদন ব্যয় ও ব্যাংক নির্ভরতা হ্রাসের পাশাপাশি টাকার বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে মনোযোগ দিয়েছে। তার ভাষ্য, ‘আমাদের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। খরচ কমানো ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমরা ক্রমাগত উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োগ করছি।’
আহসান খান চৌধুরী আরও বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে উচ্চ সুদ ও মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, ইউটিলিটি বিল বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ লাফিয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের উচ্চ সুদহারে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, অনেক কারখানা মালিক বাধ্য হয়ে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। এটি সরাসরি ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে যারা ইতোমধ্যেই জীবিকার ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বিক্রি ও মুনাফা দুটোই কমেছে।
এ প্রসঙ্গে বিসিআই সভাপতি বলেন, ‘যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এমন অবস্থা হয় তবে তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি কতটা খারাপ তা কল্পনাও করা যায় না।’
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়িক পরিবেশ সম্পর্কে বিসিআইয়ের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন তুলে ধরে তিনি সতর্ক করেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে নীতিগত উদ্যোগ না নিলে সামনে গভীর স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।’