ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে এগোচ্ছে একটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির (বিটিএ) পথে। দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে। তিনটি ধাপে এই চুক্তি সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসেই অন্তর্বর্তী চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা শেষ হবে।
চুক্তির প্রথম ধাপে আলোচনা হবে শিল্পজাত পণ্য ও কৃষিপণ্যের বাজার এবং এসব পণ্যের গুণগত মান নিয়ে। যদিও এই পর্যায়ে শুল্ক আরোপ না করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না, জানিয়েছেন এক ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তা। তাঁর ভাষায় ট্রাম্প প্রশাসন তিন ধাপে চুক্তি সম্পন্ন করার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, ভারত চায় শ্রমনির্ভর খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্ক ছাড় আদায় করতে এবং প্রাথমিক চুক্তিতে সেই সুযোগটিই কাজে লাগাতে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংবেদনশীল খাতগুলোকে সুরক্ষা দিতে কোটাব্যবস্থা বা ন্যূনতম আমদানি মূল্য নির্ধারণ করতে পারে ভারত। এর আওতায় থাকছে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্য। এই খাতগুলোতে ভারতের বিশেষ স্বার্থ জড়িত।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষির প্রস্তাব পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দপ্তর। ৭ মে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে লেখা এক চিঠিতে ইউএসটিআরের প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার জানান, আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর আগে বাংলাদেশের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে গত মাসে বাণিজ্য উপদেষ্টা গ্রিয়ারকে এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে নেওয়া পদক্ষেপ ও আলোচনার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন।
ভারতের বাণিজ্য কর্মকর্তারা জানান, ৮ জুলাইয়ের আগে অন্তর্বর্তী চুক্তি সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। এতে পণ্য, অ-শুল্ক বাধা, ডিজিটাল সেবা খাতসহ একাধিক ইস্যু অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কর্মকর্তারা আশাবাদী, যুক্তরাষ্ট্র যেন ভারতের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ও ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্ক আরোপ না করে। পাশাপাশি শ্রমনির্ভর খাত, যেমন- বস্ত্র ও চামড়াজাত পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুল্ক ছাড় পেতে চায় ভারত।
এই প্রক্রিয়ায় গতি আনতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিক ও ইউএসটিআরের গ্রিয়ারের সঙ্গে বৈঠকের কথা জানান। গয়াল বলেন, প্রাথমিক আলোচনা ইতিবাচকভাবেই এগোচ্ছে। তবে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইউএসটিআরের দপ্তর থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ বা এমএফএন শুল্ক সুবিধা পেতে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগে। তবে যেসব দেশের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের একক ক্ষমতাতেই তা প্রত্যাহার সম্ভব। ভারতও এই তালিকায় রয়েছে।
চলমান আলোচনায় ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশ চুক্তির দিকে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ৯ জুলাই পর্যন্ত ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক স্থগিত রেখেছে। এরই মধ্যে ভারত চায় বস্ত্র, রত্ন, গয়না, চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, চিংড়ি, তেলবীজ, আঙুর, কলাসহ শ্রমনির্ভর পণ্যে শুল্ক ছাড়। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ভারত যেন নির্দিষ্ট কিছু শিল্পজাত পণ্য, বৈদ্যুতিক যান, গাড়ি, ওয়াইন, পেট্রোকেমিক্যাল, দুগ্ধজাত পণ্য, আপেল, বাদাম এবং পরিবর্তিত জিনসম্পন্ন (জিএম) কৃষিপণ্যের আমদানিতে ছাড় দেয়।
তবে ভারতে জিএম পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি বিধিনিষেধ থাকায় বিষয়টি জটিল হয়ে আছে। ভারত এখন ‘নন-জিএম’ পণ্য, যেমন- গবাদিপশুর খাদ্য আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার অভিযোগ করেছে, তাদের পণ্য ভারতে বাজারজাত করতে গিয়ে নানা অ-শুল্ক বাধায় পড়তে হচ্ছে।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে আলোচনার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এই আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। এপ্রিল মাসে যেসব খাত ও শর্তে উভয় দেশ সম্মত হয়েছিল, সেগুলোর ভিত্তিতে আলোচনার পরবর্তী ধাপ এগোবে। এই সময়ে কোয়াড জোটের শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।
তৃতীয় ধাপে চুক্তি চূড়ান্ত ও সর্বাঙ্গীণ রূপ পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে, যা ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ হতে পারে বলে এনডিটিভি সূত্রে জানা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এই চুক্তি যত দ্রুত সম্পন্ন করতে আগ্রহী, যুক্তরাষ্ট্র ততটা তাড়াহুড়া দেখাচ্ছে না। বরং তারা ধীরে চলো নীতিতেই আগাচ্ছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের পরিসংখ্যানও এই আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। এই সময়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৩১.৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ এবং আমদানির ক্ষেত্রে ৬.২২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ভারতের মোট পণ্য বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ছিল ১০.৭৩ শতাংশ।
এ সময় ভারতের পক্ষে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৪১.১৮ বিলিয়ন ডলার, আগের বছর যা ছিল ৩৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে এই উদ্বৃত্ত বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ২৭.৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ সালে ৩২.৮৫ বিলিয়ন এবং ২০২০-২১ সালে ছিল ২২.৭৩ বিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাই এখন নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সব মিলিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির পথ যতটা উন্মুক্ত মনে হচ্ছে, তার বাস্তবায়নে রয়েছে নানামুখী জটিলতা, চাপ ও কৌশলগত হিসাব-নিকাশ। এখন দেখার বিষয়, এই আলোচনায় দুই দেশ কতটা বাস্তবসম্মত ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে।