জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে সরকার দুটি নতুন বিভাগ গঠন করেছে। এর ফলে দেশের রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এখন থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি নতুন সংস্থা কাজ করবে।
তবে এই পরিবর্তন নিয়ে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি আগাম কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। ফলে রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
গত ১২ মে রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করেন। এর মধ্য দিয়ে এনবিআর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত হয়। এখন রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন তৈরি, হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি নিয়ে কাজ করবে। আর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ মাঠপর্যায়ে কর আদায়, নিরীক্ষা ও করদাতার সম্মতির বিষয়গুলো তদারকি করবে।
সরকার বলছে, এই দুটি সংস্থার মাধ্যমে নীতি ও বাস্তবায়নের কাজ আলাদা হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। পাশাপাশি দক্ষতাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, এনবিআর দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখন মাত্র ৭.৪ শতাংশ। এটা এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে বিশ্ব গড় ১৬.৬ শতাংশ। মালয়েশিয়ায় এটি ১১.৬ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের এই অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। তাই এনবিআরের কাঠামো বদল অপরিহার্য ছিল।
তিনি আরও বলেন, আগে একই প্রতিষ্ঠান নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজ করত। এতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অদক্ষতা ও অনিয়ম হতো। নতুন ব্যবস্থায় স্বার্থের সংঘাত কমবে। করজাল বাড়বে এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে।
তবে সংস্কারের পদ্ধতি নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। গত বছরের ৯ অক্টোবর সরকার একটি পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করে। এতে ছিলেন এনবিআরের দুই সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ ও ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ। সদস্য ছিলেন দেলোয়ার হোসেন, ফরিদ উদ্দিন এবং আমিনুর রহমান।
কিন্তু এই কমিটির কাজ গোপন রাখা হয়। তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। সদস্যদের অভিযোগ, সরকার তাদের সুপারিশ প্রায় উপেক্ষা করেছে। খসড়া অধ্যাদেশের সঙ্গে তাঁদের মতামতের মিল নেই বলেও তাঁরা জানান।
নতুন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের দাবি, এই পদক্ষেপ পরিকল্পিতভাবে এনবিআরকে দুর্বল করার চেষ্টা। কেউ কেউ বলছেন, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শেই এই মডেল প্রস্তাব হয়েছিল। যদিও ২০০৯ সালে সংসদে এই আইন পাস হয় বাস্তবে তা চালু হয়নি।
এবার হঠাৎ অধ্যাদেশ জারি করায় কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের দুটি সংগঠন জরুরি সভা করে অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনও একই দাবি তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছে।
কর্মকর্তাদের মতে, নতুন ব্যবস্থায় প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাব বাড়বে। এতে আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা উপেক্ষিত হবে। তাঁদের আশঙ্কা, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ নেবেন।
এই পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারা তিন দিনের কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু করেছেন। ১৩ মে থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাঁরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে তাঁরা উপস্থিত থাকলেও কোনো ফাইল প্রসেস করছেন না। কেউ আলোচনা করছেন, কেউ আবার ব্যানার ঝুলিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
অতিরিক্ত কর কমিশনার সাধন কুমার কণ্ডু জানিয়েছেন, সরকার দাবি না মানলে আরও কঠোর কর্মসূচি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের মাধ্যমে সরকার নিশ্চয়ই তাঁদের বার্তা পেয়েছে।
এই কর্মবিরতির বড় প্রভাব পড়েছে আমদানি-রপ্তানিতে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কাজ প্রায় বন্ধ। প্রতিদিন সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট আটকে আছে। এতে আমদানি-রপ্তানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা এএসএম রেজাউল করিম স্বপন জানিয়েছেন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বন্ধ থাকায় শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বিকেলের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। তবে কর্মঘণ্টা কম থাকায় আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, এই অচলাবস্থায় পণ্য ডেলিভারি বিলম্ব হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিল্প ও ভোক্তা পণ্যের সরবরাহে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ফল এবং খাদ্যপণ্য ক্ষতির মুখে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, সাধারণত প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়। এখন তা নেমে এসেছে তিন হাজারে। তিনি বলেন, স্থবিরতার প্রকৃত প্রভাব সামনে আরও বাড়বে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই অধ্যাদেশের সমালোচনা করেছে। তাঁদের মতে, এতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা হওয়া উচিত। তবে পরামর্শক কমিটির মত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি অধ্যাদেশ জারি করা ঠিক হয়নি। তিনি এই অধ্যাদেশ সংশোধনের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এফবিসিসিএফএএ) জানায়, চার দিন ধরে কাস্টমস অফিস বন্ধ থাকায় পণ্যজট তৈরি হয়েছে। এর ফলে জরুরি সেবা, উৎপাদন এবং সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটছে। তাঁরা দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চেয়েছেন।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা পাঁচ দিনের কলমবিরতির ফলে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছর মে মাসে দৈনিক গড়ে ১,১৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বৈঠক হয়। তবে এই বৈঠকে কোনো ফল আসেনি। আন্দোলনকারীদের মতে, তাঁদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
তাঁরা জানিয়েছেন, আন্দোলন চলবে। ২২ মে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে এনবিআর কর্মকর্তারা। তাঁরা এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের অপসারণও দাবি করেছেন। একই সঙ্গে ২৪ মে থেকে পূর্ণ কর্মবিরতির ঘোষণাও দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সমাধান না হলে রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে দ্রুত ও কার্যকর সংলাপ প্রয়োজন।