এক সময়ের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি এখন যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে চীনে। দেশের শহরজীবনের পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চীন নতুন এক আকাশ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই স্বল্প উচ্চতার আকাশপথ ব্যবহার করে চীন সরকার ও বেসরকারি খাত মিলিতভাবে স্বচালিত উড়ন্ত গাড়ি এবং ড্রোন প্রযুক্তিকে যাতায়াত ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
চীনে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বর্তমানে দেশটিতে স্বচালিত উড়ুক্কু যান যাত্রী পরিবহনে ব্যবহারের জন্য বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, পণ্য সরবরাহে ড্রোনের ব্যবহারও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ভবিষ্যতে শুধু দেশীয় অর্থনীতিতে নয়, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারেও নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ড্রোন ও উড়ুক্কু গাড়ির ব্যবহার এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের পর থেকে খুচরা বিক্রেতা ওয়ালমার্ট প্রায় দেড় লাখবার ড্রোন ব্যবহার করে পণ্য সরবরাহ করেছে। তবে চীনে এই প্রযুক্তি এখন আর কল্পনার বিষয় নয়, বাস্তবতার অংশে পরিণত হয়েছে। যদিও এই খাতের বর্তমান আকার এখনো তুলনামূলকভাবে ছোট, তবে এর প্রসার অত্যন্ত দ্রুত। চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে স্বল্প উচ্চতার এই আকাশ অর্থনীতির বার্ষিক আয় দাঁড়াবে দেড় লাখ কোটি ইউয়ান, যা প্রায় ২০ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। ২০৩৫ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বেড়ে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছাতে পারে।
প্রযুক্তি খাতে চীনের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি মেইতুয়ান ২০২৪ সালে ড্রোনের মাধ্যমে ২ লাখেরও বেশি পণ্য সরবরাহ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া, উড়ুক্কু গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইহ্যাংয়ের শেয়ারদর গত দুই বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা এই খাতের দ্রুত সম্প্রসারণের আরেকটি প্রমাণ। ২০২৪ সালের শেষে চীনে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ড্রোনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ লাখে। চায়না লো অল্টিটিউড ইকোনমি অ্যালায়েন্স’ এর প্রধান লো জুন জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ১০০টি কোম্পানি এই খাতে যানবাহন উৎপাদন করবে। শহর হোক বা গ্রাম, সীমান্ত হোক বা দ্বীপসবখানেই এখন ড্রোনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে।
চীনের ডাক বিভাগ ‘চায়না পোস্ট’ এখন ড্রোন দিয়ে পণ্য সরবরাহ করছে। হাসপাতালগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত সরবরাহ, কৃষিজমিতে সার ও কীটনাশক ছিটানো, উচ্চ ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণ, সীমান্তে মাদক চোরাচালান ঠেকাতে নজরদারি এবং রোগ নির্ণয়ের নমুনা দ্রুত ল্যাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজেও ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২৩ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং ‘লো অল্টিটিউড ইকোনমি’-কে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পরই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পাশাপাশি ড্রোন ও উড়ুক্কু যানও সরকারি পরিকল্পনার কেন্দ্রে চলে আসে। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ খাতের জন্য আলাদা বিভাগ চালু করেছে। সরকার এখন স্পষ্ট করে বলছে—ড্রোন ও উড়ুক্কু যান কল্পনা নয়, বাস্তবতা। যদিও ড্রোন প্রযুক্তিতে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, উড়ুক্কু গাড়ির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। দেশটির প্রধান গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এই নতুন প্রযুক্তি উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দীর্ঘদিন চীনের আকাশপথ ছিল সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে। আকাশপথের প্রায় ৯০ শতাংশ সামরিক ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ থাকায় বেসামরিক কার্যক্রম সীমিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার স্বল্প উচ্চতার আকাশপথ খুলে দিতে শুরু করেছে। ৬০০ মিটার নিচের আকাশসীমা ব্যবহার করতে শেনজেন, হেফেইসহ ছয়টি শহরকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হয়েছে ‘লো অল্টিটিউড প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিষয়ে পাঠ্যক্রম। অর্থনৈতিক মন্দার সময় অনেক জেলা প্রশাসন এই নতুন শিল্পে সম্ভাবনা খুঁজছে এবং অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের আশায় এগিয়ে আসছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, চীন এখন আকাশে এক নতুন অর্থনীতির দিগন্ত উন্মোচন করছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির চিত্রগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়ে, তারা শুধু প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই নয়, আগামী প্রজন্মের জীবনযাত্রার মানেও আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।