বাংলাদেশের পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক গভীর সংকটে পড়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। একীভূকরণ ছাড়া উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কার্যকর একীভূকরণে বিপুল অর্থের প্রয়োজন।
সরকার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বাকি অর্থ জোগাড় করা হবে স্পন্সর পরিচালকদের জব্দ করা শেয়ার বিক্রি করে। যেসব শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব হবে না, সেগুলো স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—এই পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের ব্যবধান ৩৮ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। ঋণখেলাপি ও আমানত উত্তোলনের চাপেই তৈরি হয়েছে এই বিপর্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এত বড় মূলধন ঘাটতি নিয়ে এসব ব্যাংক চলতে পারে না। আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি যেন তারা ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে দেয়।”
এই পাঁচ ব্যাংকে কর্মরত প্রায় ১৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নিচের স্তরের কর্মীরা চাকরি নিয়ে আশ্বস্ত থাকলেও শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য কোনো নিশ্চয়তা নেই। গভর্নর জানান, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একীভূকরণ কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। তবে এ সময় পর্যন্ত গ্রাহকরা স্বাভাবিক লেনদেন চালিয়ে যেতে পারবেন।
এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এক সময় এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখনো এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ খেলাপি ঋণ ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট জটিলতার সঙ্গে গ্রুপটির নাম জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালকদের মালিকানাধীন শেয়ার জব্দ করেছে। এক্সটার্নাল অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৮ শতাংশ, এসআইবিএলের ৬০ শতাংশ, আর বাকি তিন ব্যাংকে তা ৯৫ শতাংশ। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ৭০ শতাংশই খেলাপি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু তারা ঋণ দিয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এতে তৈরি হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার ব্যবধান। নির্ধারিত ৯২ শতাংশ অগ্রিম-আমানত হার (এডিআর) মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, যা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে ফেলেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একীভূকরণের আগে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব রেজল্যুশন প্ল্যান চাওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, “এক্সিম ও এসআইবিএল অন্য তিনটির মতো এতটা বিপর্যস্ত নয়। তাদের সম্মতি ছাড়াই একীভূকরণ কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয়?” তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার সম্ভাবনা না থাকলে, কেন তাদের অবসায়ন বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না?” কর্মী ছাঁটাই ও শাখা হ্রাস না করে কর্মীদের নিরাপত্তার আশ্বাস বাস্তবসম্মত নয় বলেও মত দেন তিনি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “অতিরিক্ত ব্যাংক সংখ্যা ও সংকটপূর্ণ অবস্থার কারণে একীভূকরণ যৌক্তিক, তবে নতুন সত্ত্বা টেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে টেকসই মডেল তৈরি করতে হবে।” তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সম্পদ বিক্রি ও একীভূকরণ কাঠামো নিয়ে কাজ করছে।
২০২৫ সালের ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, সংকটে পড়া ব্যাংক সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় আনা যাবে। ‘ব্রিজ ব্যাংক’ মডেলেও সমাধান সম্ভব, যেখানে একটি নতুন ব্যাংক গঠন করে মূল ব্যাংকের সম্পদ, দায়, অধিকার ও বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করা হয়। সঞ্চয়ী আমানতের সুদের হার অপরিবর্তিত থাকলেও, অন্যান্য আমানতের হার পরিবর্তন করা যাবে। মূল ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করে, ব্রিজ ব্যাংক শর্তসাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি, একীভূতকরণ বা লিকুইডেশন করতে পারবে।
ব্রিজ ব্যাংকের পরিচালনায় থাকতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত “যোগ্য ও উপযুক্ত” ব্যক্তি। এর মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। কাজ সম্পন্ন হলে এই ব্যাংক অন্য প্রতিষ্ঠানে একীভূত বা বিক্রি করা যেতে পারে, অথবা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হবে।