বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশযাত্রা একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ তার সামনে এক অন্ধকার ছায়া ফেলছে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও শিল্পায়নের স্বপ্ন আজ চরম ঝুঁকিতে পড়েছে এই খেলাপি ঋণ নামক মহামারীর কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন খেলাপি ঋণ এখন কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি সামাজিক আস্থাহীনতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং শাসন ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের নানামুখী সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক বছরের মতো ২০২৪ সালে বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ পুনরায় খেলাপি হয়েছে। গত বছর ব্যাংক খাতে ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধা নিয়ে খেলাপিরা নবায়ন করেছিলেন। ওই বছর পর্যন্ত নবায়ন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনরায় খেলাপি হয়েছে।
গত বছর সরকার পরিবর্তনের আগে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের ঋণ বিশেষ ছাড়ে নবায়ন করা হয়েছিল। সেগুলোর কিস্তি পরিশোধ না করা হলেও ব্যাংক তা খেলাপি করেনি; নিয়মিত হিসাবেই রেখে দিয়েছিল। সরকার পতনের পর সেসব ঋণ খেলাপি হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই কারণে নবায়ন করা ঋণ গত বছর বেশি খেলাপি হয়েছে।
খেলাপি ঋণের বর্তমান চিত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে খেলাপি, পুনঃতফসিল ও রাইট-অফ মিলিয়ে হিসেব করলে এই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৫%। এই পরিমাণ ঋণ কেবল আর্থিক সূচকের জন্য হুমকি নয়, বরং এটি জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে পৌনে লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মোট খেলাপির মধ্যে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা মন্দ (আদায় অযোগ্য) ঋণে পরিণত হয়েছে। ফলে যত খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তত বেশি ব্যাংকের সম্পদের মান কমছে। পাশাপাশি ব্যাংকের আয় কমায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তখন ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষ ছাড়ে ২০২০ সালে মোট নবায়ন করা ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওই বছর পুনরায় খেলাপি হয়েছিল ২৯ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে মোট নবায়ন করা ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪০১ কোটি টাকায়। ওই বছর পুনরায় খেলাপি হয়েছিল ৩২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। ২০২২ সালে নবায়ন করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। পুনরায় খেলাপি হয়েছিল ৪১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে মোট নবায়ন করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ফের খেলাপি হয়েছিল ৫৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা।
২০২৪ সালে খেলাপি ঋণের স্থিতি যেমন বেড়েছে, তেমনই নবায়ন করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হয়েছে বেশি মাত্রায়। নবায়ন করা ঋণ সবচেয়ে বেশি খেলাপি হয়েছে শিল্প খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা বেড়েছে। এই কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। এসব সংকটে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। উল্লেখ্য খেলাপি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ১০ শতাংশের কম মূলধন ছিল ১০টি ব্যাংকের। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ১০ শতাংশ কম মূলধন রয়েছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯টি। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে আরও ৯টি ব্যাংকের মূলধন ১০ শতাংশের নিচে চলে গেছে।
১০ শতাংশের বেশি থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ মূলধন রয়েছে গত দুই বছর ধরেই ৪টি ব্যাংকের। সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশ মূলধন ছিল- এমন ব্যাংকের সংখ্যা ২০২৩ সালে ১৫টি। ২০২৪ সালে তা ৫টি কমে ১০টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বাড়ায় ৫টি ব্যাংকের মূলধন সাড়ে ১২ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছে। ২০২৩ সালে ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশ মূলধন ছিল- এমন ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ১৮টি। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪টিতে।
খেলাপি ঋণের মূল কারণসমূহের মধ্যে একটি হলো রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব। ঋণ মঞ্জুর ও পুনঃতফসিলে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপ দীর্ঘদিন ধরেই বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বল ব্যাংক পরিচালনাও খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে, অভ্যন্তরীণ অডিট দুর্বল, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যত অকার্যকর। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আইনি দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রিতাও খেলাপি ঋণের বড় কারণ। ব্যাংকিং আদালত কার্যকরভাবে মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারায় ঋণ খেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ ঋণকে ব্যবসার মূলধন নয়, বরং প্রভাব খাটিয়ে হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ হিসেবে দেখে।
উন্নয়নের স্বপ্নে ধস: বাংলাদেশ গত এক দশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু খেলাপি ঋণের পাহাড় এর বিপরীতে অর্থনীতিকে অস্থির করছে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক খাতের অস্বচ্ছলতা দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শিল্পায়নে ধাক্কা লাগছে। এসএমই উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছে না, কারণ ব্যাংকগুলো ঝুঁকির ভয়ে ঋণ বিতরণে অনিচ্ছুক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের চাপ এতটাই বেড়েছে যে, সরকারের বড় অঙ্কের পুনঃমূলধন প্রয়োজন হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের অবস্থান: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। ভারতে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় ৫%, পাকিস্তানে ৮%, নেপালে ৩% হলেও বাংলাদেশে তা সরকারি হিসেবে ১০% আর বাস্তব হিসেবে ২০%–২৫%। এই ব্যবধানই নির্দেশ করে বাংলাদেশের তথ্য ও বাস্তবতার মধ্যে এক বড় অমিল রয়েছে।
খেলাপি ঋণের সামাজিক প্রভাব: এর ফলে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কমছে। অনেকেই ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে দ্বিধা বোধ করছেন। দিন দিন অসাম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও সাধারণ ব্যবসায়ীগণ ঋণ না পেয়ে ধুঁকছে। এতে বৈষম্য বাড়ছে। আর নৈতিক সংকট ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋণ শোধ না করেও সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখার প্রবণতা সমাজে ভুল বার্তা দিচ্ছে।
সমাধানের পথ: রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ক্ষমতাসীনদের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। প্রভাবশালীদের খেলাপি ঋণ মওকুফ বা পুনঃতফসিল বন্ধ করতে হবে। আইনি সংস্কার করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ঋণ খেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করা জরুরি। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স অর্থাৎ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করে পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সাথে সাথে জনসচেতনতা বৃদ্ধি কল্পে ঋণ শোধ করাকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে অস্বস্তির মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। বস্তুত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি আর্থিক খাতের অন্যান্য সূচককেও নেতিবাচক ধারায় নিয়ে যায়। বিগত সরকারের আমলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ না কমে কেন অব্যাহতভাবে বেড়েছিল, তা খতিয়ে দেখে খেলাপি ঋণ আদায়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
অতীতে কোন বিবেচনায় বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা জবাবদিহির আওতায় আনতে না পারলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তা ফেরত আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দ করতে হবে। খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে দুরারোগ্য ব্যাধির রূপ নিয়েছে। কাজেই এই খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে যত দ্রুত সম্ভব সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বপ্ন ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা না গেলে উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হবে। এখনই সময় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনি কঠোরতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে এই মহামারীর সমাধান করা। অন্যথায় দেশের উন্নয়নযাত্রা থমকে যাবে, আর ব্যাংকিং খাত হারাবে জনগণের আস্থা। সর্বোপরি খেলাপি ঋণ কেবল অর্থনীতির সমস্যা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। এখনই পদক্ষেপ না নিলে উন্নয়নের স্বপ্ন সত্যিই ডুবে যাবে।

