স্বাস্থ্য খাতকে জনসেবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বলা হয়। প্রচলিত প্রবাদ আছে—‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। কিন্তু নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই খাত আজ ‘সব অনর্থের মূল’-এ পরিণত হয়েছে।
সরকারি ক্রয়ে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা, নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ, পণ্য গুদামে পড়ে নষ্ট হওয়া, প্রতিযোগিতা ছাড়া একক দরদাতার মাধ্যমে কেনাকাটা, এবং পণ্য বুঝে না নিয়েও অর্থ পরিশোধ—সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাত অর্থ ও সেবার ক্ষেত্রে গুরুতর অপচয়ের মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) স্বাস্থ্য খাতের ক্রয় কার্যক্রম পর্যালোচনা করে একাধিক অনিয়মের প্রমাণ তুলে ধরেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অধীন এই প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে এবং জনগণ প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিপিপিএ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পাঁচটি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৩০টি ক্রয়চুক্তি বিশ্লেষণ করেছে। প্রতিবেদনে চুক্তির পদ্ধতি, ক্যাটাগরি, মূল্য এবং সরকারি ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়ন পর্যালোচনা করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি চুক্তি বিশ্লেষণেই কোটি কোটি টাকার অপচয় ও অনিয়মের ছবি পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে গুরুতর ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—প্রয়োজন না থাকা যন্ত্রপাতি কেনা, নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ, যন্ত্রপাতি স্থাপন না করে গুদামে রাখা, কম দামের সরঞ্জাম কেনা হয়নি, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের অযৌক্তিক ব্যবহার, একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিক চুক্তি, পণ্য বিতরণে বিলম্ব এবং সরবরাহের আগেই বিল পরিশোধ। মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কিছু পণ্য প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কেনা হয়েছে। আবার সরবরাহ করা যন্ত্রপাতি স্থাপন না করে গুদামে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়েছে।
- ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই টন ক্ষমতার দুটি এয়ার কন্ডিশনার সরবরাহের পরও ইনস্টল করা হয়নি। গুদামে ফেলে রাখায় পোকামাকড়ের আক্রমণে একটি নষ্ট হয়ে গেছে। অপারেশন থিয়েটার ও ডেলিভারি রুমের জন্য দুটি এসি কেনা হলেও আগে থেকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত প্রয়োজন যাচাই ছাড়াই সরঞ্জাম কেনা হয়েছে।
- ইউনানী মেডিকেল কলেজে ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকার কাঁচামাল ও কয়েকটি ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ চাওয়ার পরও নিম্নমানের কারণে সরঞ্জাম ব্যবহার না করে সংরক্ষণাগারে রেখেছে। তবুও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরবরাহকারীকে অর্থ পরিশোধ করেছে। বিপিপিএ জানাচ্ছে, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রয়োজনীয়তা যাচাই ছাড়াই সরঞ্জাম কেনা হয়েছে।
- মহাখালীর অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) কার্যালয়ের জন্য ‘বায়োসিস টেকনোলজিস’ থেকে ডিজিটাল অটোমেটেড আর্ম ইন বিপি মেশিন এবং ‘আজমীর ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে ডিজিটাল বিপি মেশিন ও ব্লাড গ্লুকোমিটার কেনার চুক্তি করা হয়। কিন্তু পণ্য সম্পূর্ণ সরবরাহের আগেই অর্থ প্রদান করা হয়। ওই সময়ে ‘বায়োসিস টেকনোলজিস’ ১২০ পিসের মধ্যে মাত্র ১৪ পিস সরবরাহ করেছিল। এছাড়া, এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের জন্য চুক্তিবদ্ধ পণ্য গ্রহণ না করেও ক্রয়কারী সংস্থা ১৯ কোটি ৮৭ লাখ ৩ হাজার ৩৫০ টাকা প্রদান করেছে।
ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর কার্যালয়ের জন্য বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হয় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকায়। কিন্তু একই টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল বগুড়ার ট্রেড সেন্টার, যার দর ছিল ২ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেশি দামে সরঞ্জাম কেনা হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের সরঞ্জাম ক্রয়, সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে পণ্য কেনা, পণ্য গ্রহণের আগে বিল পরিশোধসহ নানা অনিয়মের কারণে তিনটি অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অপারেশনাল প্ল্যান-২-এর একটি প্যাকেজে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে পণ্য কেনায় ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। অপারেশনাল প্ল্যান-৩ ও প্ল্যান-৫-এর কিছু প্যাকেজে পণ্য গ্রহণ না করা সত্ত্বেও বিল পরিশোধের কারণে সরকার প্রায় ২৪ কোটি টাকা ক্ষতি করেছে।
৩০টি ক্রয় কার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ‘সিমেন্স হেলথ কেয়ার লিমিটেড’ এবং ‘আজমির ইন্টারন্যাশনাল’। দুটি প্রতিষ্ঠান একক দরদাতা হিসেবে তিনটি করে কাজ পেয়েছে। তবে টাকার অঙ্কে বেশি কাজ পেয়েছিল সিমেন্স হেলথ কেয়ার লিমিটেড, যার কাজের মূল্য মোট চুক্তির ৩২.২১ শতাংশ। ‘একমি ল্যাবরেটরিজ’ ও ‘ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যালস’ দুটি করে কাজ পেয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক টেন্ডার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সময় ও অর্থ উভয়ের অপচয় হয়েছে। বিপিপিএ প্রতিবেদনে সিএমএসডির ভেতরের কাঠামোগত দুর্বলতাকেও দায়ী করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও ক্রয় কমিটির চাহিদা যাচাই ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা, অল্পসংখ্যক সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরতা, ধীরগতি, যৌক্তিক কারণ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেন্ডার অনুমোদন এবং সরবরাহকারী কর্তৃক নিম্নমানের বা বিলম্বে পণ্য সরবরাহ।
আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা এবং অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে প্রতিবেদনে অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জানিয়েছেন, ‘বিপিপিএর প্রতিবেদন হাতে পেলেই অনিয়ম অনুসন্ধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা ও অনিয়মের কারণে সরকারি অর্থ অপচয় হচ্ছে, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরঞ্জামের অভাব দেখা দিয়েছে এবং চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিযোগিতাহীন ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিপিপিএর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্পষ্ট যে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে। কোটি কোটি টাকার অপচয় রোধ করতে এবং চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার ক্রয় ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি।

