বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ চলতি বছরের জুনে ১,৪৬,৩৬২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। শুধুমাত্র ছয় মাসে এই ঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশ বেড়েছে। বিপুল এই ঋণের মধ্যে ১,৩২,৪৯৯ কোটি টাকা বা ৯০ শতাংশেরও বেশি ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ, এই ঋণের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা প্রায় নেই।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের সতর্কবার্তা। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো অর্ধডজন দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকের জন্য উদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করছে। সেই প্রেক্ষাপটে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পিছনে ১৫ বছরের লুটপাট:
অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো—গত কয়েক বছরে খেলাপি অবস্থায় থাকা ঋণগুলোকে প্রকৃত খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। তিনি আরো বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের ডিপোজিট সংগ্রহ ও নতুন ঋণ দেওয়ার বাইরে গিয়ে রিকভারির দিকে বেশি নজর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার জন্য সঠিক কর্পোরেট গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা জরুরি। এর মধ্যে সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”
চেয়ারম্যান আরো যোগ বলেন, “গত ১৫ বছরে ব্যাংকগুলোতে যে লুটপাট হয়েছে, তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এক-দুই বছর যথেষ্ট নয়। বর্তমানে যে প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে তা নেট প্রফিট থেকেই পূরণ করতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলোকে শক্ত অবস্থানে ফেরাতে সময় লাগবে।” অগ্রণী ব্যাংকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সময়ে সময়ে সরকারের কাছ থেকে মূলধন সহায়তা পেয়েছে। তবে আমাদের ব্যাংকের ক্ষেত্রে নতুন করে মূলধন ইনজেকশনের প্রয়োজন নেই। বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বকেয়া আদায় করা গেলে ব্যাংকের আর্থিক সূচক ঘুরে দাঁড়াবে।”
জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭৬ শতাংশ:
চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২৫ সালের জুন শেষে এর মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ খেলাপি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২,১০৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৬৭,৮৮৪ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৯৩ শতাংশ ইতোমধ্যেই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিত।
ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হার মারাত্মকভাবে ঋণাত্মক, যা –৩.২৫ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ বাফারসহ ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ থাকতে হবে। অর্থাৎ ব্যাংকটি তার নিজস্ব মূলধনের চাহিদা পূরণেও ব্যর্থ। লোকসান কিছুটা কমলেও এখনও উদ্বেগজনক। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে জনতা ব্যাংক ২,০৭১ কোটি টাকা নেট ক্ষতি দেখিয়েছে, যা আগের ছয় মাসে ৩,৭০ কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি।
সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণে তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থানে:
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি দেখা গেছে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১৮.২০ শতাংশ। অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যেখানে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ, সেখানে সোনালী ব্যাংক সফল। ২০২৫ সালের জুনে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০.১০ শতাংশ—যা ন্যূনতম ১০ শতাংশের শর্ত পূরণ করে। একই সময়ে ব্যাংকটি ছয় মাসে ৫৯১ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সোনালী ব্যাংকের এই সাফল্য প্রতিষ্ঠানটির সঠিক কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এবং ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের ফল। তুলনামূলকভাবে কম খেলাপি ঋণ এবং মূলধনের যথাযথ সংরক্ষণ ব্যাংকটিকে অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ৪০% ঋণ খেলাপি:
২০২৫ সালের জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২,২৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০.৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি—যা গত বছরের ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত। মোট খেলাপি ঋণের ৮৭ শতাংশ ইতোমধ্যেই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিত। নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ হার (সিআরএআর) ১২.৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন মাত্র ১.৯৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে অনেক পিছিয়ে। নেতিবাচক সূচকের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক খবর আছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ১১৪ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে, যা ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসের ৯৩৬ কোটি টাকার ক্ষতির তুলনায় ভালো।
রূপালী ব্যাংকের ৪৪% ঋণ খেলাপি:
২০২৫ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২,১৭৯ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪১.৫ শতাংশ। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯১ শতাংশ ইতোমধ্যেই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিত। নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ হার (সিআরএআর) ১২.৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু রূপালী ব্যাংকের মূলধন মাত্র ২.৮৬ শতাংশ, যা নিয়মের চেয়ে অনেক কম। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই কম মূলধন হার ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি নেট মুনাফা করেছে মাত্র ৮.৩৪ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসের ৬৪.৪৯ কোটি টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার এবং সীমিত মুনাফা রূপালী ব্যাংকের পুনরুদ্ধারে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সাম্প্রতিক আর্থিক চিত্র উদ্বেগজনক। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭৬ শতাংশ এবং রূপালী ব্যাংকের ৪৪ শতাংশ—এই দুই ব্যাংক সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্রণী ব্যাংকও ৪০ শতাংশ ঋণ খেলাপি অবস্থায়, যেখানে মূলধন সংকট স্পষ্ট। অন্যদিকে, সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে এবং মূলধন সংরক্ষণে সাফল্য দেখিয়েছে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, এই ঋণ ও মূলধন সংক্রান্ত সমস্যা শুধু প্রতিটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নয়, দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের সতর্কবার্তা। দীর্ঘমেয়াদে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, প্রভিশন পূরণ এবং শক্তিশালী কর্পোরেট গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা না করলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে এবং আর্থিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থাৎ, ব্যাঙ্কগুলোকে শুধুমাত্র ক্ষতি কমানো নয়, বরং স্থায়ীভাবে শক্তিশালী ও ঝুঁকি প্রতিরোধী করে তোলা জরুরি। এটি সরকারের নীতি, ব্যাংক প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।

