দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর ফলে খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার এখন ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশের মধ্যে। কার্যত এসব প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া অবস্থায়। গ্রাহকরা আমানত ফেরত পাচ্ছেন না, আবার নতুন ঋণ বিতরণও বন্ধ হওয়ার পথে। এক মাস আগে ৯টি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান অবসায়নের (লিকুইডেশন) সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও প্রক্রিয়া এখনো তেমন এগোয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি আর পরিকল্পিত লুটপাটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পথে গেছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও তাদের ঘনিষ্ঠরা ঋণের নামে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। দ্রুত সংস্কার না হলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত তো দূরের কথা, গোটা আর্থিক খাতই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, এনবিএফআই খাত তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বরং অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ তছরুপ হয়েছে। তিনি অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক্সিট পলিসির আওতায় এনে দ্রুত বন্ধ করার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে এনবিএফআই খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর আগে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও পুনঃতফসিলের নামে প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে কঠোর নজরদারিতে আসল অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে ৩৫টি এনবিএফআই কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন এবং ১৩টি যৌথ মালিকানাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি উচ্চ খেলাপি ঋণ ও আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেছে। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠান—এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স—বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র মো. শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানান, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে প্রক্রিয়া এখনো পর্যালোচনা পর্যায়ে আছে। সরকারের অনুমোদন ও অর্থ সহায়তা পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ ছাড়া ঝুঁকির মধ্যে থাকা অন্য ১৩টি প্রতিষ্ঠানও নজরদারিতে আছে। এর মধ্যে রয়েছে সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, উত্তরা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটালসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এদের খেলাপি ঋণও ৫০ শতাংশের বেশি।
এনবিএফআই খাতের দুরবস্থা নতুন নয়। আলোচিত পি কে হালদার কেলেঙ্কারির পর থেকেই পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। তার মালিকানাধীন ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব এখন পুরো খাতেই পড়ছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণ আর কমছে আমানতকারীদের আস্থা।

