বাংলাদেশের এয়ারলাইনগুলো বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে নেওয়া বিভিন্ন সেবার জন্য আদায়কৃত অতিরিক্ত সারচার্জের বোঝায় কঠিন সংকটে পড়েছে। স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোর কাছে বেবিচকের মোট পাওনা এখন দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৫১ কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের বিমান খাতে এক বিশাল আর্থিক চাপ তৈরি করেছে।
স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোর মতে, এই উচ্চ সারচার্জের বোঝা “অসহনীয়” পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইতিমধ্যে অন্তত তিনটি বেসরকারি বিমান সংস্থা বকেয়া পরিশোধ না করে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। অন্য সংস্থাগুলোও বকেয়া পরিশোধ করতে করতে হিমশিম খাচ্ছে। বেবিচকের তথ্যানুসারে, মোট বকেয়ার ৭৮ শতাংশ, প্রায় ৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, এই সারচার্জ থেকে এসেছে।
সারচার্জে বৈষম্য
ভারত ও পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশে বিমানবন্দরে বছরে ১২–১৮ শতাংশ সারচার্জ নেওয়া হয়, যেখানে বাংলাদেশে অ্যারোনটিক্যাল বিল দেরিতে পরিশোধের জন্য বার্ষিক ৭২ শতাংশ সারচার্জ ধার্য করা হয়েছে, যা মাসিক হিসাব করলে ৬ শতাংশ হয়। অন্যদিকে, এই অঞ্চলের সিঙ্গাপুরে এই হার ৮ শতাংশ এবং ওমানে ১০ শতাংশ।
দেশের ৮টি বিমানবন্দরে বেবিচক মোট ছয় ধরনের অ্যারোনটিক্যাল সেবার চার্জ নেয়, যেমন: নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, রানওয়ে, এপ্রোন এরিয়া, টার্মিনাল, বোর্ডিং ব্রিজ, অ্যাম্বারকেশন ওভার ফ্লাই/ল্যান্ডিং এবং বিমান পার্কিং। সময়মতো বিল না পরিশোধ করলে এ চার্জের ওপর অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপিত হয়।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মুখপাত্র মো. কামরুল ইসলাম বলেন, “যাত্রীসংকট ও নানা জটিলতার কারণে অনেক সময় বিমান সংস্থা যথাসময়ে বিল পরিশোধ করতে পারে না। কিন্তু সারচার্জ মাসিক ৬ শতাংশ হওয়ায় এটি আমাদের জন্য ভীষণ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই হার মাত্র ১ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই হার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছি। এটি কমলে সংস্থাগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ত এবং ব্যবসা আরও টেকসই হতো।”
এয়ারলাইনস অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব মফিজুর রহমানও বলেন, “উচ্চ সারচার্জ দিয়ে দ্রুত টাকা আদায় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে এটি বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। ফলে এয়ারলাইনগুলোকে বকেয়া পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে।”
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল জানান, “ছয় ধরনের অ্যারোনটিক্যাল এবং চার ধরনের নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ নিয়মিত আদায় করা হয়। যেসব বিল সময়মতো পরিশোধ হয়নি, তার কারণে বিপুল বকেয়া জমে গেছে। আমরা নিয়মিত এয়ারলাইনগুলোকে চিঠি দিয়ে স্মরণ করাই।”
বড় বিমানের বেশি বকেয়া
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে বেবিচকের কাছে দেশের পাঁচটি সরকারি ও বেসরকারি এয়ারলাইনের মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৫১ কোটি টাকারও বেশি। সবচেয়ে বড় বোঝা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের। এখানে বেবিচকের পাওনা ৬ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৪ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকারও বেশি সারচার্জ।
বেসরকারি এয়ারলাইনগুলোর ক্ষেত্রেও বকেয়ার বড় অংশই সারচার্জ। তিনটি সংস্থা—ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এবং জিএমজি এয়ারলাইনস—ই ইতিমধ্যে কার্যক্রম বন্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেট ফুয়েলের দাম, সীমিত মূলধন এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এই উচ্চ সারচার্জ তাদের সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের স্বতন্ত্র পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “মূল দেনা ৫৭ কোটি টাকা পরিশোধের প্রস্তাব দিলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সেটি নাকচ করে দেয়। সারচার্জের চাপে সংস্থাটির পুনরায় চালুর স্বপ্ন ভেস্তে যায়।”
রেকর্ড মুনাফা এবং বকেয়া
গত অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৯৩৭ কোটি টাকা মুনাফা ঘোষণা করলেও চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৩ হাজার ৬৯১ কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার পাওনা আছে। সংস্থার সাবেক মুখপাত্র এ বি এম রওশন কবির বলেন, “পুরনো বিলের ওপর সারচার্জের কারণে এই টাকা পরিশোধ হয়নি। আমরা হালনাগাদ বিল নিয়মিত পরিশোধ করি এবং বকেয়া নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা চলছে।”
সারচার্জ কমানোর সম্ভাবনা
বেবিচকের পরিচালক এস এম লবলুর রহমান স্বীকার করেন, “সারচার্জের হার সরকার নির্ধারণ করে। আমরা শুধুমাত্র সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তা কার্যকর করি। তবে ১৮ শতাংশে কমানোর বিষয়টি চূড়ান্ত বিবেচনায় রয়েছে। পুরনো বকেয়ার সারচার্জ কমানো বা মওকুফ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এ জন্য বিমান সংস্থাগুলোকে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে।”
ফলে, ৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা সারচার্জ বাবদ জমে থাকা এই বিশাল বকেয়া কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।

