রাজনৈতিক প্রভাব ও বড় ব্যবসার স্বার্থ এক হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতি নতুন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ মতো শক্তির হাতে চলে যায়। এমন সতর্কতা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) আয়োজিত ‘মান্থলি ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশে ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানি এ ধরনের প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করেছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। তিনি বলেন, শুধু সম্পদ জব্দ করলেই চলবে না, এগুলো রাষ্ট্রীয় তহবিলে ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে।
ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, খারাপ ঋণ বা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের পরিবার যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তবে তাদের হিসাব জব্দ করা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থার সংকট তৈরি করছে। তিনি প্রস্তাব দেন, সীমিত কিছু ক্ষেত্রেই হিসাব জব্দের ব্যবস্থা রাখা উচিত, বিশেষ করে যাদের ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অর্থপাচারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জানান, ওয়াশিংটনের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি ইনস্টিটিউটের হিসাবে ২০০৪ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। তবে একটি টাস্কফোর্সের প্রধান বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে এ পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, “অতিরঞ্জন না করে সতর্কভাবে এগোতে হবে এবং কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”
তিনি স্বীকার করেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ধরনের দুর্নীতি ঘটেছে। তবে তিনি আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, “নিজস্ব সমাধান বের করতে হবে। সাহসী নীতিনির্ধারণ জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কর আদায় বাড়ানো।” ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, তাদের কাজ নীতিনির্ধারণ। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক পর্ষদ ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করে। নীতি প্রণয়ন ও ঋণ দেওয়ার কাজ আলাদা হওয়া উচিত।
আলোচনায় পিআরআই প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কিছু ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও দক্ষতা রক্ষা না করলে আবারও নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান ঘটতে পারে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি. রহমান বলেন, অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলেও প্রবৃদ্ধি মন্থর। সাম্প্রতিক প্রান্তিকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে উন্নতি দেখা গেলেও বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশার নিচে এবং মুদ্রাস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, কোনো দেশই পুরোপুরি অর্থপাচার রোধ করতে পারে না। আমাদের ব্যর্থতা হলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এখনও অনেকেই বিদেশে স্থায়ী হওয়ার আগেই অর্থ পাচার করছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আমলা, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রভাবের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তিনি বলেন, “আজ যারা অর্থ পাচার করছে, তারা আমাদেরই নাগরিক সমাজের অংশ। রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”