চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা শিল্প এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা গোল্ডেন ইস্পাত কারখানা এখন নিস্তব্ধ। একসময় ফার্নেসের আগুনে গলত টন টন ইস্পাত, ঝরে পড়ত এমএস রডের ধারা। আজ সেখানে নীরবতা। কয়েক মাস আগেও ৫৫০ শ্রমিক কাজ করলেও এখন ছাঁটাই হয়েছেন ৪৫০ জন। হাতে গোনা ১০০ স্থায়ী কর্মীকে রাখা হয়েছে শুধু সুদিন ফেরার আশায়।
একই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান এইচএম স্টিলও টিকে আছে অর্ধেক শক্তিতে। দৈনিক এক হাজার টনের উৎপাদন ক্ষমতা কমে নেমেছে ২৫০-৩০০ টনে। তিন শিফটের জায়গায় চলছে দুই শিফট। এখানেও ৮০০ কর্মীর মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন ২০০ জন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সরওয়ার আলম জানান, লোকসান ঠেকাতে একটি কারখানা বন্ধ ও অন্যটির উৎপাদন বড় পরিসরে কমাতে হয়েছে। তবুও মাসে ৪-৫ কোটি টাকা ক্ষতি গুনতে হচ্ছে।
গোল্ডেন ও এইচএম স্টিলের মতো পরিস্থিতি অন্য কারখানাগুলোতেও। চট্টগ্রামের কেআর স্টিল, বায়েজিদ স্টিল, সীমা স্টিল, শীতলপুর স্টিল, ঢাকার পিএইচপি স্টিলসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। দৈনিক হাজার টনের সক্ষমতা থাকা বহু কারখানা এখন খালি শেডে দাঁড়িয়ে। যারা টিকে আছে, তারাও সক্ষমতার বড় অংশ ব্যবহার করতে পারছে না।
কারণ একটাই—নির্মাণ খাত থমকে যাওয়া। সরকারি ও বেসরকারি বড় প্রকল্পগুলো এক বছর ধরে কার্যত বন্ধ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নতুন কোনো বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। পুরোনো প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড়ও হয়েছে ধীর গতিতে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে ইস্পাত শিল্পে।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ ধাতুর দাম টনে ১,২০০ টাকা কমলেও দেশীয় বাজারে রডের দাম কয়েক মাসে কমেছে ৭-৯ হাজার টাকা। মে মাসে যেখানে ৭৫ গ্রেডের এমএস রড ছিল ৯০ হাজার টাকার ওপরে, এখন মিলগেটে বিক্রি হচ্ছে ৮০,৫০০ থেকে ৮২,৫০০ টাকায়। ৬০ গ্রেডের দামও ৮৪ হাজার থেকে নেমে এসেছে ৭৪ হাজারে। উদ্যোক্তাদের হিসাব, প্রতি টনে লোকসান হচ্ছে ৬-৮ হাজার টাকা।
কাঁচামাল আমদানিতে আগে যেখানে ১০ শতাংশ মার্জিন জমা রাখতে হতো, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০-৬০ শতাংশ। সুদের হারও বেড়ে যাওয়ায় ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়েছে। এর সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বেতন বাবদ মাসে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ মেটাতে হচ্ছে কারখানাগুলোকে। ফলে উদ্যোক্তাদের জন্য এটি দাঁড়িয়েছে টিকে থাকার লড়াই।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানিয়েছে, দেশে উৎপাদিত রডের ৬২-৬৫ শতাংশ ব্যবহার হয় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক আবাসন খাতে ব্যবহার হয় বাকি ৩৫ শতাংশ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুমন চৌধুরী বলেন, নতুন প্রকল্প কার্যত নেওয়া হচ্ছে না। আগের প্রকল্পেও অর্থ ছাড় ধীরগতির। এ কারণেই রডের চাহিদা ভেঙে পড়েছে।
বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, নির্মাণ খাতের গতি না থাকায় ইস্পাতসহ বহু খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিক্রি কমেছে, দাম কমেছে, ফলে বিনিয়োগকারীরা মারাত্মক চাপে পড়েছেন।
কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন জানান, উৎপাদন খরচ ও বাজারদরের অমিলের কারণে গত বছরের আগস্ট থেকে কারখানার উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদক কেএসআরএম দিনে ২,৫০০-৩,০০০ টন রড উৎপাদন করলেও এখন সেটি নেমে এসেছে হাজার টনের নিচে। প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, সরকারি প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ। চাহিদা ৬০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে, কারণ রড বেশি দিন মজুত রাখা যায় না।
কারখানার সংকট বাজারেও আঘাত করেছে। চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জে মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এস এম কামরুজ্জামান জানান, আগে দিনে ৩০০-৩৫০ টন রড বিক্রি করতেন, এখন তা নেমে এসেছে ৫০ টনের নিচে।
সব মিলিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে। দেশে ২০০টির বেশি ইস্পাত কারখানা থাকলেও এর মধ্যে ৪০টি বড় প্রতিষ্ঠান মূল উৎপাদন সামলাচ্ছে। তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১ কোটি ১০ লাখ টন হলেও চাহিদা মাত্র ৭৫ লাখ টন। অথচ এই চাহিদাও এখন তৈরি হচ্ছে না।
উদ্যোক্তাদের আশা, সরকার দ্রুত নতুন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে, পুরোনো প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করলে এবং কম সুদে গৃহঋণের সুযোগ দিলে ইস্পাত শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে যত দিন যাচ্ছে, অনিশ্চয়তার ঘন মেঘ ততই গাঢ় হচ্ছে।

