বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের আর কয়েক মাস ধরে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। খুব শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈশ্বিক ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের অনুমোদন দেবে। এতে রপ্তানিকারকরা দ্রুত নগদ অর্থ পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
এই ডিজিটাল ব্যবস্থায় রপ্তানিকারকরা ক্রেতা-স্বীকৃত ইনভয়েস অনলাইনে আপলোড করবেন। এরপর ক্রেতার ঋণযোগ্যতা যাচাই করে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওই ইনভয়েস কিনতে দরপত্র দেবে। রপ্তানিকারক চাইলে প্রকৃত অর্থের চেয়ে কিছুটা কম অগ্রিম টাকা সঙ্গে সঙ্গে পেতে পারবেন। কয়েক মাসের অপেক্ষা শেষ হবে কয়েক দিনের মধ্যেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিলম্বিত অর্থ পরিশোধ বা ডেফার্ড পেমেন্ট। অনেক ক্রেতা সুনামের কারণে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নেয়। এরপর বিল মেটাতে সময় নেয় ১২০ দিন পর্যন্ত। কিন্তু রপ্তানিকারকের দরকার পড়ে তাৎক্ষণিক নগদ অর্থ—কারখানা চালু রাখতে, নতুন অর্ডার নিতে, বেতন দিতে কিংবা উৎপাদন খরচ মেটাতে।
বর্তমানে রপ্তানি বিলের বিপরীতে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ রপ্তানিকারক তা পান না। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর রপ্তানিকারকরা উন্নত সমাধান চাইছিলেন। এই প্ল্যাটফর্ম সেই চাহিদা পূরণ করবে। স্থানীয় ব্যাংকগুলোও এতে যুক্ত হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ডিসকাউন্ট রেট হবে SOFR+4 (প্রায় ৮ শতাংশ)। ফলে রপ্তানিকারকরা এর বেশি ডিসকাউন্ট দিতে বাধ্য হবেন না।
কীভাবে কাজ করবে এই প্ল্যাটফর্ম
ট্রেড ফাইন্যান্স ডিসকাউন্টিং একটি ডিজিটাল ব্যবস্থা। রপ্তানিকারক পণ্য পাঠানোর পর আমদানিকারকের ইনভয়েস অনলাইনে আপলোড করবেন। প্ল্যাটফর্ম বা ক্রেতার ব্যাংক ক্রেডিট রেটিং যাচাই করবে। এরপর ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারীরা অর্থায়নের প্রস্তাব দেবে। রপ্তানিকারক প্রকৃত ইনভয়েসের চেয়ে কিছুটা কম অগ্রিম পাবেন।
উদাহরণস্বরূপ, এক লাখ ডলারের ইনভয়েসের বিপরীতে তিনি ৯৭ হাজার ডলার আগাম পেতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ে আমদানিকারক পুরো অর্থ দিলে ফাইন্যান্সার তাদের টাকা ফেরত পান। এতে রপ্তানিকারক ব্যাংক ঋণ ছাড়াই নগদ অর্থ পেয়ে নতুন অর্ডার বা উৎপাদন চালাতে পারবেন।
বিশ্বজুড়ে সক্রিয় কয়েকটি বড় প্ল্যাটফর্ম হলো—মার্কো পোলো নেটওয়ার্ক (জার্মানি), কমগো (সুইজারল্যান্ড), কনটোর (সিঙ্গাপুর), ট্রেড লেন্স (ডেনমার্ক/যুক্তরাষ্ট্র), বোলেরো (যুক্তরাজ্য), ইনকমলেন্ড (সিঙ্গাপুর) এবং ট্রেডস (ভারত)।
বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশে কিছু সীমিত ডিসকাউন্টিং সুবিধা ইতোমধ্যে চালু আছে। এইচএসবিসি ও প্রাইম ব্যাংক আংশিকভাবে ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং ও রিসিভেবল ফাইন্যান্সিং দিচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত নয়।
সোনালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রি-শিপমেন্ট ও ব্যাক টু ব্যাক ফাইন্যান্সের মাধ্যমে রপ্তানি বিলে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থায়ন হয়। কিন্তু পোস্ট-শিপমেন্ট অর্থায়ন যথেষ্ট নয়। তিনি আরও জানান, “নগদ রপ্তানি আদেশে ব্যাংক সর্বোচ্চ আট কার্যদিবস পর্যন্ত বিনা সুদে অর্থায়ন দেয়। কিন্তু ডেফার্ড এলসিতে ১৩.২৫ শতাংশ বাণিজ্যিক সুদে অর্থায়ন করতে হয়।”
আইসিসি’র তথ্যমতে, বৈশ্বিক ট্রেড ফাইন্যান্সের চাহিদা প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। ডিজিটাল ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্ম এই ঘাটতি পূরণের সুযোগ তৈরি করছে।
বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে। পাশাপাশি চামড়া, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যও উল্লেখযোগ্য। ব্যাংকারদের মতে, মোট রপ্তানির অর্ধেকের বেশি হয় ডেফার্ড এলসিতে।
সুবিধা ও ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্ল্যাটফর্ম রপ্তানিকারকদের তাৎক্ষণিক নগদ অর্থ এনে দেবে। বিশেষ করে যেসব ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ পেতে সমস্যায় পড়েন—তাদের জন্য এটি হবে বিকল্প সমাধান। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক ডিসকাউন্ট রেটও পাওয়া যেতে পারে।
তবে ঝুঁকিও আছে। বিদেশি অর্থায়নকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যেতে পারে। দেশের ব্যাংকগুলো যদি সক্রিয়ভাবে অংশ না নেয়, রপ্তানিকারকরা বাইরের প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভর হয়ে পড়বেন। সঠিক কাগজপত্র ও রেকর্ড-রাখার অভাবে অনেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা নাও পেতে পারে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আছে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “ডেফার্ড পেমেন্ট এখন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। আগে ২১ দিনের মধ্যে পেমেন্ট মিললেও এখন ১০৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অথচ রপ্তানিকারককে ব্যাক টু ব্যাক এলসির টাকা আগেই পরিশোধ করতে হয়। তাই ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং জরুরি।”
বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম বলেন, অনেক সময় ক্রেতা ৬০ থেকে ৯০ দিনের শর্ত দেয়। বাধ্য হয়ে রপ্তানিকারকরা মানেন। কিন্তু ব্যাক টু ব্যাক এলসির টাকা মেটাতে তখন ঋণ নিতে হয়, যেখানে সুদ অনেক বেশি। তিনি বলেন, “যদি বৈদেশিক মুদ্রা কয়েক দিনের মধ্যে মেলে, তাহলে রপ্তানিকারকের জন্য বড় সুবিধা হবে।”
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর মনে করেন, এই উদ্যোগ দেরিতে হলেও জরুরি। তিনি বলেন, “অনেক ক্রেতা ৩০ থেকে ৯০ দিন পর টাকা দেয়। শর্ত না মানলে তারা অন্য দেশ থেকে পণ্য নেয়। তাই আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়া প্রতিযোগিতা বাড়াবে। তবে ডিসকাউন্টিং খরচ বেশি হলে লাভ হবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমী) আলী বলেন, “গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সুযোগ রপ্তানিকারকদের বড় বাজারে নিয়ে যাবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং দরকার।”

