জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও জনবান্ধব করার জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মুনাফা ঘোষণা, সুরক্ষা স্কিমে চাঁদার হার বৃদ্ধি, আউটসোর্সিং কর্মীদের স্কিমে অন্তর্ভুক্তি, ইসলামিক ভার্সন চালুর উদ্যোগ এবং স্কিমে বিমা সুবিধা সংযোজনের পরিকল্পনা।
সচিবালয়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং অর্থ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তৃতীয় সভা গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দীন খান বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন। অর্থ বিভাগের সচিবসহ অন্যান্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জানানো হয়, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৭ জন চাঁদাদাতার কাছ থেকে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রারম্ভিক স্থিতিসহ জমাকৃত মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৭ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৪ টাকা ১৫ পয়সা। এই অর্থে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্জিত মোট মুনাফা হয়েছে ১৬ কোটি ৩৩ লাখ ৪ হাজার ২৩ টাকা ৭৭ পয়সা। পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগের সময়কাল অনুযায়ী চাঁদাদাতাদের হিস্যাভিত্তিক মুনাফা প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা তাদের পেনশন আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে মুনাফার তথ্য দেখতে পারবেন। এই অর্থবছরে সর্বোচ্চ মুনাফা হার নির্ধারিত হয়েছে ১১.৬১ শতাংশ।
নিবন্ধনসহ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের যাবতীয় কার্যক্রম বর্তমানে ডিজিটাল ওয়েব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালনা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও জনগণের মোবাইলনির্ভর জীবনযাত্রার বাস্তবতা বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ একটি মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপ করেছে। এটি শিগগিরই সাবস্ক্রাইবারদের জন্য উন্মুক্ত হবে। সভায় আরও জানানো হয়, সুরক্ষা স্কিমটি মূলত স্বনিযুক্ত নাগরিকদের জন্য। এখানে নিম্ন ও উচ্চ আয়ের মানুষ উভয়েই অংশ নিচ্ছেন। বর্তমানে এই স্কিমে সর্বোচ্চ মাসিক চাঁদার সীমা ৫ হাজার টাকা। তবে উচ্চ আয়ের নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সর্বোচ্চ সীমা ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ব্যক্তি যেমন কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি পেশার মানুষদের জন্য চালু করা সুরক্ষা স্কিম গ্রহণ করেছেন ৬৩ হাজার ৬২৪ জন। তাদের জমা চাঁদার পরিমাণ ৫৪ কোটি ৭৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য চালু প্রবাস স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ৯৯৪ জন, যার পরিমাণ ৭ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এই পদক্ষেপের ফলে সুরক্ষা স্কিমটি প্রগতি স্কিমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এখন থেকে আউটসোর্সিং সেবাকর্মীরাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যোগ দিতে পারবেন। তারা প্রগতি স্কিমে অংশ নিতে পারবেন, যেখানে সাধারণত সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা। তবে সেবাকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় এই হার কমিয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাঁদার পুরো অর্থ কর্মীর দায়িত্বে থাকবে, নিয়োগকর্তার কোনো অবদান থাকবে না। পরিষদ একটি ইসলামিক ভার্সন চালুরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে শরিয়াহ-সম্মত বিনিয়োগ কাঠামোয় পেনশন স্কিম পরিচালনা করা যাবে। আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা করে ধারণাপত্র দ্রুত প্রস্তুত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বিমা সুবিধা সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। অ্যাকচুয়ারি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ধারণাপত্র দ্রুত প্রস্তুত করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুবিধা চালু হলে অংশগ্রহণকারীরা অবসরকালীন নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবন বিমার আওতায় থাকবেন। সভায় উপস্থিত সদস্যরা বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম দেশের সামাজিক সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরমূলক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। তারা জনসাধারণের আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিনির্ভর সেবা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সভা শেষে নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দীন খান বলেন, সরকারের লক্ষ্য প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ অবসরকাল নিশ্চিত করা। পেনশন স্কিমের বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ। সূত্রে জানা যায়, প্রায় ছয় লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে পেনশন স্কিমের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ১৬ এপ্রিল একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রস্তাব প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কিমে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবেদন পেশ করবে।
একজন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, “বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু। ইসলামিক ভার্সন না থাকায় ধর্মপ্রাণরা স্কিমে আসছেন না। ফলে নিবন্ধনের গতি কম। তাই চারটি স্কিমের ইসলামিক ভার্সন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।” তিনি বলেন, ইসলামিক স্কিম চালু করার পরিকল্পনা এবং বিমা সুবিধা সংযোজন, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্তি, পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ গ্রহণের বিষয়গুলোেও কাজ চলছে। নিবন্ধনের গতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন জেলায় মেলা আয়োজনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা বাড়ছে।