দেশে বর্তমানে ২৩২টি স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। জনবল রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। বিপুল সম্পদ ও বড় কর্মীবল থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে মুনাফা করতে পারেনি। বরং এ সময়ে তারা ৫ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে।
সরকারকে এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তার জন্য ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিতে হয়েছে। পাশাপাশি, এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংকের ঋণের দায়ও সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে অনেক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক নজির দেখা গেছে। তবু এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ সমস্যা সমাধানে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়নের কাজও চলছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এখনো সরকারের সংস্কার এজেন্ডায় নেই। প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট জনবল ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৪০ জন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ও অপরিচালন খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী ৭৫ হাজার ৪২ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত থাকলেও, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত নিট লোকসান হয়েছে ৫ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
এই সময়ে সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থনে ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) এবং বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি)। এই প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৭ বছর টানা লোকসানের মুখে রয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্প খাতের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নিট লোকসান হয়েছিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। সেবা খাতের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের লোকসান ছিল ৫ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয়েছে ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। সেবা ও অন্যান্য খাতের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকায়। লোকসানের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—
- বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি): ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা
- ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি): ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা
- বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি): ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা
- বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি): ৫৭১ কোটি টাকা
- বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি): ২২৬ কোটি টাকা
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মতামত জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, এগুলো সরকারের কোষাগারের জন্য বিরাট বোঝা। এসব প্রতিষ্ঠানকে করপোরাটাইজড করেও ফল পাওয়া যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে মোটাদাগে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কারে পদক্ষেপ এখনও হয়নি।
যেসব প্রতিষ্ঠানকে সরকার সংস্কারের উদ্যোগে নিয়েছে, সেগুলো শেষ করতে পারলে একটি নজির তৈরি হওয়া সম্ভব। সবকিছু একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে হবে। আর্থিক ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পারফরম্যান্স অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। সেখান থেকে শুরু করে অন্যান্য খাতে যাওয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আদমজী জুট মিল এর উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, সেগুলো শেষ করে বাকিগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়া উচিত। তখন তারা আরও বড় আকারে সংস্কার করতে পারবে এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।”
রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা ও পেশাদারিত্বের অভাবে ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে লাভজনক হতে পারছে না। দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বেসরকারি মোবাইল অপারেটররা গ্রাহক আকর্ষণ এবং মুনাফা দুটোকেই বজায় রাখতে পারলেও সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০২০ সালে গ্রাহকসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির বাজার অংশীদারত্ব ছিল ২.৮৮ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৫০ শতাংশে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টেলিটকের প্রায় ১৮০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।
একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সরকারের দেওয়া সুবিধার সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। সংস্থাটি অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ সংগ্রহ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে। তবু গত ৫৪ বছরে এটি ভালো এয়ারলাইনসের অবস্থানে যেতে পারেনি। ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি, ফ্লাইট বাতিল, সূচি পরিবর্তন, ভাড়া বেশি থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের মান নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে বিমান।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন পরিষেবা দিয়ে সংস্থাটি ২৮২ কোটি টাকার মুনাফা দেখালেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার দায়দেনায় জর্জরিত। লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার প্রতি বছর বাজেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের বোঝাও সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা চলছে, এবং অধীনে থাকা সম্পদ ও জমি অলস অবস্থায় পড়ে আছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, জনবল ও দক্ষতার দিকে কোনো নজর দেওয়া হয়নি। ফলে এদের পারফরম্যান্স খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রয়োজন। যেগুলো রাখা জরুরি, সেগুলোকে সংস্কার করতে হবে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে, তার তুলনায় সরকারের যে পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে তা ব্যয়সংক্রান্তভাবে সাশ্রয়ী নয়। এগুলো সরকারি সম্পদের অপচয়।”
বছরের পর বছর লোকসানে থাকা এবং রাষ্ট্রের ভর্তুকি নেওয়ার পরও অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ কর্মীদের অনৈতিকভাবে বিভিন্ন ধরনের বোনাস দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবই এই অনৈতিক চর্চার মূল কারণ। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরূপণে ফরেনসিক অডিট জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন পরিস্থিতি বেশ নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠানে হিসাবমান অনুসরণ না করে মনগড়া আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি, নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করা, এবং আর্থিক তথ্যের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব সাধারণ চর্চায় পরিণত হয়েছে।
তাছাড়া সরকারি তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য দেখা যায়। অর্থ বিভাগের তথ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য প্রায়শই মিলছে না। উদাহরণস্বরূপ, অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন শেষে ১০১টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। অথচ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ২০২৪ সালের জুন শেষে এই ঋণ দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫২১ কোটি টাকায়। অন্য উদাহরণ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ৪ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার লোকসান দেখানো হলেও নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকার মুনাফা করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো একক কোনো আইনি কাঠামোর আওতায় না থাকায় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও জটিলতা রয়েছে। একেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে। মালিকানার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। অর্থ বিভাগ বাজেটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ দেয়, কিন্তু মালিকানা এককভাবে অর্থ বিভাগের কাছে না থাকার কারণে নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে কর্মীরা নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে।
এডিবি জানিয়েছে, বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ বিভাগের মালিকানায় নিয়ে আসা হবে। নাজুক আর্থিক পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মুখে রয়েছে। খোদ অর্থ বিভাগের মূল্যায়নে এটি উঠে এসেছে। অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল ১০১টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়ন করেছে। এতে দেখা গেছে, ৭৯টি প্রতিষ্ঠান মাঝারি থেকে অতি উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান অতি উচ্চ ঝুঁকিতে, ২৮টি প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকিতে এবং ৩৭টি প্রতিষ্ঠান মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মাধ্যমে কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে সরানো হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারের জন্য “গলার কাঁটা” হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ বিভাগকে প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় অংকের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। শ্রমিক ইস্যু ও শ্রমিক রাজনীতির কারণে হঠাৎ বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
চিনিকলগুলোর ক্ষেত্রেও লাভের সুযোগ নেই। আখ থেকে চিনি উৎপাদন বিশ্বের কোথাও আর ব্যয়সংগত নয়। বাংলাদেশে চিনি উৎপাদনে যা খরচ হয়, তা বিদেশ থেকে কম দামে চিনি আনা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে বড় অংকের ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান সংস্কার করেও লাভজনক করা সম্ভব নয়, কারণ সরকারি পদ্ধতি ও আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যবসা করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্পর্শকাতর এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করা উচিত। আর যেসব প্রতিষ্ঠান লাভজনক, সেগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়াই সমীচীন।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যার মাত্রা শুধু বাংলাদেশে নয়, পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেও দেখা যায়। অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএফসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা ও সুপারিশ রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কারের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই কার্যকরভাবে নেওয়া সম্ভব। তবে আলাদাভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান বাছাই করে সংস্কার করলে তা সফল হয় না। অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ থেকেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। তাই সার্বিকভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়াই সমাধান।” তবে সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানই লোকসানদায়ী নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক ও আর্থিক দিক থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। মুনাফার শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি): ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা মুনাফা
- বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি): ৪ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা
- চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ): ২ হাজার ৪৩ কোটি টাকা
- বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি): ১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা
- বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ): ৫৪৭ কোটি টাকা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যারা লাভজনক অবস্থায় আছে, তাদের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা এবং লোকসানদায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার বা বিকল্প ব্যবস্থাপনা করা জরুরি। সার্বিক সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।

