সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি ব্যাংকে নগদ অর্থের ঘাটতি বা তরলতা সংকট জনজীবনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, আর ব্যবসা ও শিল্পখাতও বেতন পরিশোধ, কাঁচামাল আমদানি ও দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই সংকট কেবল অর্থের ঘাটতির কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নীতিগত ফাঁকফোকর এবং কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অযোগ্য ঋণের প্রভাব।
এই ধরনের পরিস্থিতি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য সতর্কবার্তা। ব্যাংকগুলোতে তরলতার ঘাটতি এবং কিছু দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। অনেকেই নিজেদের কাছে নগদ রাখার পন্থা নিচ্ছেন, যা সংকটকে আরও তীব্র করছে। যদিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যার স্থায়ী সমাধান এখনও দেখা যায়নি। পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এখন অতীব জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতি: দেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে তারল্য সংকট বা নগদ অর্থের ঘাটতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছু দুর্বল ব্যাংক বিশেষ করে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক মারাত্মক আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। এসব ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং মূলধনের ঘাটতি তাদের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও স্বীকার করেছে, কিছু ব্যাংকের অবস্থা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সেগুলো টিকিয়ে রাখা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান ব্যাংক সংকটের অন্যতম কারণ হলো ঋণখেলাপি ও অনিয়ন্ত্রিত ঋণ ব্যবস্থাপনা। অনেক ব্যাংক বছরের পর বছর ধরে খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে তাদের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তহবিলের অপব্যবহার, ভুয়া কাগজে ঋণ প্রদান ও দুর্বল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। এসব অনিয়ম ব্যাংকগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। অনেক আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, ফলে তারা নিজেদের কাছে নগদ অর্থ রাখার প্রবণতা বাড়াচ্ছেন, যা আবার ব্যাংকের তারল্যকে আরও সংকুচিত করছে।
অন্যদিকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ব্যাংক খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস ব্যাংকের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে জরুরি তারল্য সহায়তা দিলেও অনেক ব্যাংক এখনও স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা এই বছরের জুন শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বেশিই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
যা সেপ্টেম্বর শেষে সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, জুন-২০২৫ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি ৩ হাজার ৪৮৩ জন। প্রথমবারের মতো এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খেলাপি ঋণ শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, বরং ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার জন্যও এক মারাত্মক হুমকি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে ব্যাংক খাতে আরও ধস নামবে।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের তরলতা উন্নত করতে সহায়তা করেছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা কমলেও চলতি জুন শেষে আবার বেড়েছে। এই সময়ে ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকা রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬ হাজার ৮২১। আর জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট হিসাবসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ৬৭১। সেই অনুযায়ী তিন মাসে ব্যাংক খাতের মোট হিসাবসংখ্যা বেড়েছে ৩২ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫০টি।
তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের উল্লিখিত হিসাবে মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। আর জুন শেষে এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২। আর জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি।
অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যার পাশাপাশি বেড়েছে এসব অ্যাকাউন্টে জমা টাকার পরিমাণও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মার্চ শেষে কোটি টাকার অ্যাকাউন্টে জমা করা টাকার পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। আর জুন শেষে এসব অ্যাকাউন্টে জমা করা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে এসব অ্যাকাউন্টে জমা বেড়েছে ৯৭ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
তবুও খেলাপি ঋণ এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। বিশেষজ্ঞগণ অভিমত দিয়েছেন যে, বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খেলাপি ঋণের চাপই ব্যাংকের তারল্য সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানোর অন্যতম মূল কারণ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ব্যাংক খাতের সংকট একদিকে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণের ফল, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপ ও নীতিগত ব্যর্থতার প্রতিফলন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো পুনর্গঠন ও একীভূত করার উদ্যোগ সফল হলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে এখনই প্রয়োজন সাহসী ও বাস্তবসম্মত ব্যাংক সংস্কারের উদ্যোগ।
জনমনে আতঙ্কের বর্তমান পরিস্থিতি: দেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা দেওয়া তারল্য সংকট জনমনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিছু ব্যাংকে নগদ অর্থের ঘাটতি এবং সময়মতো আমানত ফেরত দিতে বিলম্বের ঘটনা গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ব্যাংক থেকে টাকা না পেলে তাদের সঞ্চয় নিরাপদ থাকবে না। ফলে কিছু গ্রাহক একসঙ্গে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা ব্যাংকগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে এবং সংকটকে আরও গভীর করছে।
এই অবস্থায় ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধারে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বেশিরভাগ ব্যাংক নগদ ব্যবস্থাপনা জোরদার করেছে, ঋণ বিতরণে সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন নীতি গ্রহণ করছে যাতে তারল্য স্থিতিশীল থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়ানো এবং ব্যাংক খাতের তদারকি জোরদার করার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।
এছাড়া ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর আর্থিক দায়িত্ব সুদৃঢ় ব্যাংকের অধীনে আনা হচ্ছে, যাতে গ্রাহকদের আমানত নিরাপদ থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট জানিয়েছে, কোনো আমানতকারী তাদের টাকা হারাবে না, যা জনগণের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে এখন ধীরে ধীরে স্থিতি ফিরছে। আমানত বাড়ছে, কিছু ব্যাংক তাদের তারল্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে এবং নগদ প্রবাহে উন্নতি হচ্ছে। যদিও আস্থার সংকট পুরোপুরি দূর হয়নি, তবুও ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করছে, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
সমস্যার সমাধানের পথ: বর্তমান ব্যাংক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংস্কার। কিছু ব্যাংককে একীভূত করা, পুনর্গঠন করা এবং দক্ষ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা গেলে তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। সাথে সাথে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি ব্যাংকের ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়া, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতার মানদণ্ডে স্বচ্ছতা আনলে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে এবং অনিয়মের সুযোগ কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তারল্য সহায়তা প্রদান করাই যথেষ্ট নয়; ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করা, নিয়মিত অডিট এবং প্রয়োজনমতো তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া ব্যাংকিং খাতকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হবে। সর্বোপরি ব্যাংক সংস্কার, স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হলে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন সম্ভব এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
সমাধানের পথ: ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে এখন প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক ও কঠোর পদক্ষেপ। প্রথমেই ব্যাংক ব্যবস্থায় আইন প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা লুট করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম, ভুয়া ঋণ বিতরণ ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে না পারলে এই সংকট আরও গভীর হবে।
একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্থ যদি পুনরুদ্ধার করা যায়, তবে ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য ফিরে আসবে এবং স্বাভাবিক লেনদেন কার্যক্রম বজায় থাকবে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণও একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হিসেবে সামনে এসেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যাতে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হয় এবং ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে দক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধু তারল্য সহায়তা প্রদান নয়, বরং নিয়মিত অডিট, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি চালাতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকের পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আর্থিক দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ব্যাংকের অর্থ নিয়ে খেলা না করতে পারে।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার ব্যবহারও সংকট উত্তরণের আরেকটি উপায়। অনলাইন লেনদেন, স্বচ্ছ হিসাবপদ্ধতি এবং গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন জনগণের আস্থা বাড়াবে এবং ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরতা পুনরুদ্ধার করবে। সবশেষে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করাও অত্যন্ত জরুরি। সরকারের উচিত ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা, গৃহীত পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জনসাধারণকে স্পষ্টভাবে জানানো। এতে অযথা গুজব ও আতঙ্ক কমবে এবং সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে তাদের আমানত এখনো নিরাপদ।
সার্বিকভাবে কঠোর আইন প্রয়োগ, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণ এবং আধুনিক ব্যাংকিং প্রযুক্তির প্রয়োগ এই পাঁচটি দিক একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যাংক খাত পুনরায় স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা ফিরে পাবে।
ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক তারল্য সংকট আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক গভীর দুর্বলতাকে সামনে এনেছে। জনগণের সঞ্চয়ই ব্যাংকের মূল শক্তি, আর সেই আস্থা যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন পুরো আর্থিক ব্যবস্থাই ঝুঁকির মুখে পড়ে। তবে এই সংকট অমোচনীয় নয়। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, দুর্বল ব্যাংক সংস্কার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে ধীরে ধীরে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই কিছুটা ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। আমানত বাড়ছে, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া এগোচ্ছে এবং ব্যাংকগুলোও দায়িত্বশীলতার জায়গায় ফিরে আসছে। এখন দরকার দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংক পরিচালনা নিশ্চিত করা। সবশেষে বলা যায়, জনগণের অর্থের নিরাপত্তাই অর্থনীতির স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। যদি ব্যাংক খাতকে সত্যিকারের জবাবদিহিমূলক, পেশাদার ও নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে আনা যায়, তবে এই সংকটই হতে পারে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনের এক নতুন সূচনা।

