বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দ্বৈতচিত্র স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। আমানত বাড়ছে কিন্তু ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ১৭ মাস পর ব্যাংক আমানতের হার দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত আমানত বেড়ে ১০ দশমিক ০২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন—৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে। অর্থনীতিতে এই বৈপরীত্য নির্দেশ করছে, মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখছে কিন্তু বাজারে সেই টাকা কাজে লাগছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আগের মাসে আমানত ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এটি দুই অঙ্কে (১০.৪৩ শতাংশ) পৌঁছেছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ কমে যাওয়াই আমানত বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তিন মাস আগেও এসব সিকিউরিটিজে সুদ ছিল ১১-১২ শতাংশ, এখন ৯-১০ শতাংশ। ফলে ব্যক্তি ও করপোরেট বিনিয়োগকারীরা সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে টাকা সরিয়ে ব্যাংকে জমা রাখছেন।
পূবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী বলেন, “ট্রেজারি বিল-বন্ডে আকর্ষণ কমে গেছে। তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আবার ব্যাংকে আমানত রাখছে। তারল্য এখন কিছুটা স্বস্তিতে আছে।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও বলেন, “ট্রেজারি বন্ডের ফলন কমায় আমানত কমছিল, এখন তা পুনরায় বাড়ছে। ব্যাংকের নগদ অবস্থান শক্ত হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদ ৯.৫০ শতাংশ, ১৮২ দিনের ৯.৭১ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের ৯.৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি (৫–২০ বছর) ট্রেজারি বন্ডের হার ৯.৩৩–৯.৮৯ শতাংশের মধ্যে।
এক ঊর্ধ্বতন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার কিনে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থ (‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’) গত এক বছরে ৫.৫ শতাংশ কমে ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
অপরদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগস্টে কমে ৬.৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন। উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগে আস্থাহীনতা প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। গড় ঋণ সুদ ১৪–১৫ শতাংশ হওয়ায় নতুন শিল্প বা ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে উদ্যোক্তারা সংকোচ করছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন- “উচ্চ সুদ ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বাধা দিচ্ছে। স্থিতিশীলতা ফিরলে ঋণপ্রবাহ বাড়বে।”
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ খেলাপি ঋণ, সুদবাজারের অস্থিরতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি নীতি নতুন ঋণ বিতরণে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, “আমরা শুধু উৎপাদনমুখী ও রফতানিতে সহায়ক খাতেই ঋণ দিচ্ছি।”
বর্তমানে ব্যাংক খাতে গড় আমানত-ঋণ অনুপাত (এডিআর) ৮২ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৮৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখন দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে—ব্যাংকে টাকা বাড়ছে, উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ স্থবির।
অর্থনৈতিক চাপের কারণে সরকারি সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও কমেছে। আগস্টে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ কম। মূল্যস্ফীতি বেড়ে সেপ্টেম্বর মাসে ৮.৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে সরকারি বাজেট ও ব্যক্তিগত অবসর নির্ভরশীলদের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা পড়ছে, তবে বাস্তবায়ন ধীর। ২০২৫ সালের জানুয়ারি–আগস্টে সরকারি সংস্থা ও হাইটেক পার্কের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ১.৮৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৬৫ কোটি ডলার এসেছে বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে। অ্যাডভান্সড টেক্সটাইল, ওষুধ, আইটি, মেডিকেল ডিভাইস ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আগ্রহ দেখা গেছে।
বিদেশি বিনিয়োগে আশার সূচনা দেখা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি–জুনে নিট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ৬১.৫ শতাংশ বেড়েছে, মূলত পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য এবং ঋণপ্রবাহের কমতির মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। সুদহার স্থিতিশীল করা, বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং নীতি সমন্বয় করলে এই দ্বৈতচিত্র দূর করা সম্ভব।
বাণিজ্যিক বিনিয়োগে গতি বাড়লে বাজারে টাকা প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, যা উৎপাদনমুখী এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও ত্বরান্বিত করবে।