বিশ্বজুড়ে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে বিনিয়োগ করে লাভ তো দূরের কথা, অনেক সময় মূলধন ফেরত পাওয়াই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
এই সংকট দূর করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন ‘মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে বিএসইসির ওয়েবসাইটে, যেখানে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত জনগণের মতামত গ্রহণ করা হবে।
মেয়াদি ফান্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে আর কোনো ক্লোজ-এন্ড বা মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হবে না। অর্থাৎ, মেয়াদ নির্দিষ্ট করে চালু হওয়া ফান্ডের যুগ শেষ হতে যাচ্ছে।
বিদ্যমান মেয়াদি ফান্ডগুলো যদি বাজারদর ধরে রাখতে না পারে, তাহলে তাদেরও অবসায়ন বা বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তর করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড আর টিকবে না।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, “নতুন বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের পর আর কোনো মেয়াদি ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হবে না। উন্নত দেশগুলো যেভাবে বেমেয়াদি কাঠামোয় যাচ্ছে, আমরাও সেই পথে যাচ্ছি। বিদ্যমান ফান্ডগুলো তাদের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত চালু থাকবে।”
কেন এই পরিবর্তন
সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অনিয়ম, দুর্বল বিনিয়োগ ও অর্থের অপচয় এই খাতকে গভীর সংকটে ফেলেছে। বর্তমানে প্রায় সব মেয়াদি ফান্ডের ইউনিটমূল্য ফেসভ্যালুর নিচে নেমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা চাইলেও ন্যায্য দামে ইউনিট বিক্রি করতে পারছেন না।
৩৭টি তালিকাভুক্ত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে মাত্র ৪টির ইউনিট দর ১০ টাকার ওপরে। বাকিগুলো ৩ থেকে ৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। ২৭টি ফান্ডের রিজার্ভ ঘাটতি ৬৫৩ কোটি টাকার বেশি, যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত দুই বছরে ৬টি ফান্ড অনিয়মিতভাবে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে আরও ১১টি ফান্ড যুক্ত হয়েছে। ফলে ২০টির মধ্যে মাত্র ৪টি সামান্য লাভ দেখিয়েছে, আর ১৬টি লোকসান করেছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি ফান্ড নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পেরেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, “দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও আস্থাহীনতার কারণে ফান্ডের ইউনিট দর এখন শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্যের অর্ধেকের নিচে। অতীতে সম্পদ ব্যবস্থাপকরা যেভাবে অর্থ পাচার করেছে, তা উদ্ধার না করলে আস্থা ফিরবে না।”
খসড়া বিধিমালায় বিদ্যমান মেয়াদি স্কিমগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গেজেট প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে যদি কোনো স্কিমের ইউনিটপ্রতি গড় বাজারদর ঘোষিত নিট সম্পদমূল্যের (NAV) চেয়ে ২৫ শতাংশের বেশি কমে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহ্বান করতে পারবে।
সেখানে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে সিদ্ধান্ত হলে, বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে ফান্ডটি বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তর বা অবসায়ন করা যাবে।
নতুন বিধিমালায় বিনিয়োগের ক্ষেত্র সীমিত করা হয়েছে। ফান্ডের অর্থ কেবল স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ, আইপিও, রাইট শেয়ার ও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাবে।
তালিকাচ্যুত, এসএমই বা এটিবি প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। কোনো সিকিউরিটিজ যদি পরবর্তীতে মূল বোর্ড থেকে বাদ পড়ে, তবে ছয় মাসের মধ্যে বিনিয়োগ তুলে নিতে হবে।
নতুন কাঠামোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য আল-আমিন বলেন, “নতুন বিধিমালায় শুধু ‘এ’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক ও ট্রাস্টিদের অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ বন্ধ হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ফান্ড খাতে স্বচ্ছতা ও আস্থা বাড়াবে।”
বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, “আমরা এমন বিধান আনছি, যাতে ফান্ডগুলো নিট সম্পদমূল্যের কাছাকাছি দরে লেনদেন হয়। যদি কোনো ফান্ড তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তরিত হবে বা অবসায়নে যাবে।”
তিনি আরও জানান, নতুন আইনে ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব আলাদা করে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কেউ ফান্ডের অর্থ নিজেদের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
তবে মেয়াদি ফান্ড সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করাকে সবাই সমাধান মনে করছেন না। ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, “মেয়াদি ফান্ডের একটা সুবিধা হলো—এগুলো তুলনামূলকভাবে সিকিউরড ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু সম্পদ ব্যবস্থাপকদের তহবিল তছরুপের কারণে আস্থা নষ্ট হয়েছে। তাই কাঠামো বাতিল নয়, সুশাসন ও তদারকি বাড়ানোই হতে পারে টেকসই সমাধান।”

