আগামী ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। এই পরিস্থিতি দেখেই সরকারের প্রশাসনিক ব্যস্ততা বাড়তে পারে, মাঠের কাজ কমতে পারে—এমন আশঙ্কায় এবার আগেভাগে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের গতি ধরে রাখতে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে ছয় মাস আগে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, এবারের লক্ষ্য ডিসেম্বরের মধ্যেই সংশোধিত আরএডিপি চূড়ান্ত করা। অর্থাৎ অর্থবছর শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই উন্নয়ন বাজেটের কাঠামো তৈরি করতে চায় সরকার, যাতে নির্বাচনের সময়ে প্রকল্পের কাজ থেমে না যায়।
এ লক্ষ্যে ইআরডি থেকে উপসচিব জিনাত রহমান স্বাক্ষরিত চিঠি ইতিমধ্যে ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলোর ঋণ ও অনুদান বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ইআরডির সচিবের সভাপতিত্বে ২ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এনইসি ভবনে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে, তাদের প্রকল্পের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ চাহিদা তুলে ধরতে হবে। ইআরডি সতর্ক করেছে, নির্ধারিত সময়ে তথ্য না দিলে পরে আর সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনের বছরে সরকারি প্রকল্পে সাধারণত কিছুটা ধীরগতি আসে। মাঠের কর্মকর্তারা নির্বাচনী দায়িত্বে ব্যস্ত থাকেন, ফাইল ঘোরাতে সময় লাগে, অনেক প্রকল্পের কাজ থেমে যায়। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই এবার আগাম আরএডিপি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে এই তথ্য চাওয়া হতো।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, “গত বছর প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রত্যাশার নিচে ছিল। এবারের নির্বাচনের সময়ও জানুয়ারি থেকে কাজ ধীর হতে পারে। তাই আগেভাগেই আরএডিপি প্রস্তুত রাখা জরুরি, যাতে উন্নয়ন কার্যক্রম থেমে না যায়।”
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা আসবে স্থানীয় উৎস থেকে, আর বৈদেশিক সহায়তা থাকবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত—৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির এক চতুর্থাংশের বেশি। এরপর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি, শিক্ষা খাত ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি, গৃহায়ণ খাত ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি এবং স্বাস্থ্য খাত ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পাবে।
তবে এসব বরাদ্দের বিপরীতে প্রকল্প অনুমোদনের হার ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মাত্র তিনটি একনেক সভা হয়েছে। সেখানে ৩৫টি প্রকল্পে অনুমোদন মিলেছে মাত্র ২২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় মনে করছে, এখনই গতি না আনলে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হবে।
গত অর্থবছরের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এডিপি শেষ পর্যন্ত নেমে এসেছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটিতে। তার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার এডিপি। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ অর্থই অব্যবহৃত থেকে গেছে।
এই অভিজ্ঞতা থেকেই সরকার এবার পরিকল্পনা ও অনুমোদনের কাজ আগেভাগে শেষ করতে চায়। নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক চাপ থাকলেও উন্নয়নের গতি যেন কমে না যায়—এই লক্ষ্যেই নতুন ছন্দে এগোচ্ছে আরএডিপি প্রণয়নের প্রক্রিয়া। বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ সফল হলে নির্বাচনের সময়ও উন্নয়ন কার্যক্রম সচল থাকবে। ব্যর্থ হলে আগের বছরের মতো বাজেট বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবে।

