বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারগুলো—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ওমান। অথচ এদের মধ্যে এখন টিকে আছে শুধু সৌদি বাজার। বাকি তিনটি দেশেই কর্মী পাঠানো একেবারে বন্ধ। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও এই বাজারগুলো চালু করা যায়নি। সৌদি আরবেও নানা জটিলতা তৈরি হওয়ায় বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার দিন দিন কমছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বিদেশে গেছেন ৮ লাখ ১৩ হাজার ৬৪ জন বাংলাদেশি কর্মী। আগের দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০২২ সালে এই সময়ে বিদেশে গিয়েছিলেন প্রায় ৮ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী, আর ২০২৩ সালে ৯ লাখ ৯০ হাজারের কাছাকাছি। তুলনায় এবার বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।
অভিবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে উদ্বেগজনক হারে। একসময় ভরসার জায়গা হিসেবে বিবেচিত সৌদি আরবেও তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা—অবৈধ অভিবাসন, মানবপাচার, আইন লঙ্ঘন ও দক্ষ কর্মীর অভাবে সৌদি বাজারও ঝুঁকিতে।
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, গত বছর পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া ৯টি শ্রমবাজারের একটিও এখনও চালু করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমানসহ একাধিক দেশের সঙ্গে বৈঠক হলেও ফল আসেনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন,
“আমরা ভেবেছিলাম, বর্তমান সরকার অন্তত শ্রমবাজার নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এখনো তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাজার গবেষণা করে নতুন শ্রমবাজার খোলা ও বন্ধ বাজারগুলো পুনরায় চালুর উদ্যোগ এখন সবচেয়ে জরুরি।”
সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গন্তব্য শ্রমবাজার—প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মী প্রতিবছর সেদেশেই যান। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া ৮ লাখের বেশি কর্মীর মধ্যে ৫ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি গেছেন সৌদি আরবে। কিন্তু সেই বাজারেও বাড়ছে নতুন প্রতিবন্ধকতা।
এখন ‘তাকামুল’ নামে দক্ষতা পরীক্ষার একটি সনদ ছাড়া সৌদিতে যাওয়া যাচ্ছে না। এই পরীক্ষায় পাস করতে হয় প্রতিটি পেশার কর্মীকে। পরীক্ষার ফি প্রায় ৫০ ডলার, সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, সময় ও জটিল প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে ভোগান্তি বাড়ছে কর্মীদের।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এটি সৌদি সরকারের নীতি, তারা এতে হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। তবে কর্মীরা অভিযোগ করছেন, এতে সময়, খরচ ও মানসিক চাপ—সবই বেড়ে যাচ্ছে।
গত সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ওমানের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এখন পর্যন্ত একটিও পুনরায় চালু করতে পারেনি। কয়েক দফা বৈঠক হলেও ফলাফল শূন্য।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক উদ্যোগ না বাড়ালে বাজারগুলো আবারও হারিয়ে যাবে। নতুন বাজার তৈরি করতেও প্রয়োজন গবেষণা ও পরিকল্পিত কৌশল।
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এজন্য ‘জাপান সেল’ নামে একটি বিশেষ ইউনিটও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা ভিন্ন।
বিএমইটির তথ্যে দেখা যায়, এ বছর ৯ মাসে জাপানে গেছেন মাত্র ৯৬২ জন কর্মী। ৬২টি রিক্রুটিং এজেন্সি পুরো ছয় মাসেও একজন কর্মী পাঠাতে পারেনি। ফলে মন্ত্রণালয় তাদের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে।
গত বছর মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৭ হাজার কর্মীর মধ্যে প্রায় আট হাজারকে বাছাই করেছে দেশটি। তবে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁদের পাঠানো সম্ভব হবে কি না, তা এখন অনিশ্চিত। কারণ, নিয়োগদাতার পক্ষ থেকে এখনো কোনো চাহিদাপত্র পাঠানো হয়নি।
বোয়েসেল জানিয়েছে, তারা প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে প্রশিক্ষণ, সাক্ষাৎকার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ফ্লাইটের সব আনুষ্ঠানিকতা সময়মতো শেষ করা কঠিন। ফলে কর্মীরা রয়েছেন দোটানায়।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত একসময় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস। কিন্তু এখন একের পর এক বাজার হারিয়ে সেই খাত দিশাহারা। যদি দ্রুত নতুন বাজার খোঁজা, পুরনো বাজার খোলা ও দক্ষ কর্মী তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়—তাহলে এই খাতের ওপর আসতে পারে বড় ধাক্কা।

