নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না—বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন এখন এক নিঃশব্দ সংগ্রামের পথে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি আর আস্থাহীনতার দোলাচলে দেশের অর্থনীতি আজ দাঁড়িয়ে আছে এক অচল মোড়ে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ—সবাই একমত, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে এই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ব্যবসায়ী মহলে এখন কিছুটা আশার আলো। তাদের বিশ্বাস, নির্বাচনের পরই হয়তো বিনিয়োগে নতুন গতি ফিরবে, স্থবির উৎপাদনচক্রে আসবে প্রাণ। কিন্তু এর আগে নয়—এই ‘অপেক্ষার ঘূর্ণি’ থেকে অর্থনীতি বেরোতে পারছে না।
একই মত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, বাংলাদেশ এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার সংকটে ভুগছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসা ও বিনিয়োগ—দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ। আইএমএফও (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের পরবর্তী কিস্তি তারা ছাড়বে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলছেন, “অর্থনীতি এখন যেন নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না।” তার ভাষায়, “মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, আর বেকারত্ব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্নাতক পর্যায়ের প্রতি তিনজনের একজন এখন কর্মহীন।”
তিতুমীর মনে করেন, “বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। হয় এই স্থবিরতা মেনে নিতে হবে, নয়তো সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক মডেলে পথ খুঁজে নিতে হবে।”
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলছেন, “দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। কোনও জাতীয় বিনিয়োগনীতি না থাকায় দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য নেই।”
অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন সবাই অপেক্ষায়—আইএমএফ, বিদেশি ক্রেতা, এমনকি দেশীয় উদ্যোক্তারাও। কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, “নির্বাচন নিয়ে যত দিন অনিশ্চয়তা থাকবে, তত দিন অর্থনীতি সচল হবে না। সরকারকে এখনই স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে—নির্বাচন কবে হবে এবং সেটি যেন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়।”
২০২২ সালে আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। পাঁচ কিস্তি ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে, কিন্তু ষষ্ঠ কিস্তি ঝুলে আছে নির্বাচনের অপেক্ষায়। সংস্থাটি এখন অর্থনৈতিক সূচকের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও ‘মূল শর্ত’ হিসেবে দেখছে।
রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া বলছেন, “ম্যানুফ্যাকচারিং, রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং—সব খাতেই বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। আইএমএফ এখন অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার সংকট নিয়েই চিন্তিত।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ২২ শতাংশ। নতুন প্রকল্প প্রায় বন্ধ, পুরোনোগুলোর সম্প্রসারণও থেমে গেছে। অনেক বিনিয়োগকারী এখন সম্পদ বিদেশে স্থানান্তর করছেন—যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক সংকেত।
পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব বলছে, আগস্ট ২০২৫-এ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশে—যা স্বাভাবিক সময়ের প্রায় অর্ধেক। সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে, ফলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থের জোগান সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, আগস্টে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬ শতাংশে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেখানে এই হার ২-৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষের হাতে টাকার প্রবাহ কমেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি—মানে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাচ্ছে।
সরকারি হিসাব বলছে, দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। নারী নির্যাতন, সামাজিক অপরাধ ও বেকারত্ব একসঙ্গে বেড়ে সমাজে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
তৈরি পোশাক খাত—বাংলাদেশের রপ্তানির প্রাণ—সেটিও এখন বিপর্যস্ত। শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে শত শত পোশাক কারখানার স্যাম্পল পুড়ে গেছে, ফলে রপ্তানি কমপক্ষে এক মাস পিছিয়ে পড়বে। বিজিএমইএ বলছে, প্রকৃত ক্ষতি কয়েকশ কোটি টাকায় গড়াবে।
সরকারের এক উপদেষ্টা সম্প্রতি দাবি করেছেন, “অর্থনীতি এখন আইসিইউ থেকে কেবিনে এসে বাড়ি ফিরছে।” কিন্তু বাস্তব সূচকগুলো ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে—বিনিয়োগ থেমে আছে, চাকরি কমছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, আর ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি মানুষকে চেপে ধরছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, “অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও, টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।”
সবশেষে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ স্পষ্ট—
“বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক ‘অপেক্ষার ঘূর্ণি’তে আটকে আছে। এই ঘূর্ণি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমেই দরকার একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যাতে রাজনৈতিক আস্থা ফিরে আসে। তাহলেই অর্থনীতি আবার হাঁটতে শিখবে।”

