ভাবুন তো, বহু পরিশ্রমের টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনলেন—নিজের পরিবারের জন্য, জীবনের সঞ্চয় উজাড় করে। বছর দুয়েক ধরে সেই ফ্ল্যাটেই বসবাসও করছেন নিশ্চিন্তে। হঠাৎ একদিন সকালে দেখলেন, দরজার সামনে ঝুলছে একটি নোটিশ—আপনার ফ্ল্যাট ব্যাংকের নিলামে উঠেছে।
এ যেন সিনেমার দৃশ্য নয়, ঢাকার শত শত ফ্ল্যাটমালিকের এখন বাস্তব জীবন।
কারণ, কিছু আবাসন কোম্পানি নির্মাণের আগেই ব্যাংকের কাছে প্রকল্পটি বন্ধক রেখে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ক্রেতাদের কাছে সে খবর গোপন রেখেছে। পরে যখন কোম্পানি খেলাপি হয়, ব্যাংক মামলা করে এবং আদালতের রায়ে সম্পত্তি নিলামে তোলে। তখনই হতবিহ্বল ক্রেতারা জানতে পারেন, তাদের কেনা ফ্ল্যাটের ওপর আসলে মালিকানা নেই।
হাইকোর্টের নথি বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১,০৭৬টি রিট মামলা হয়েছে—যার সঙ্গে জড়িত ক্রেতাদের বিনিয়োগ প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা। শুধু এ বছরই শতাধিক আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে এসব মামলা চলছে।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানও ভয়াবহ—
-
২০২৪ সালে ৭৫৪টি রিট (১,০৫০ কোটি টাকার বেশি জড়িত)
-
২০২৩ সালে ৮১৩টি রিট (১,০০০ কোটি টাকা)
-
২০২২ সালে ৬১৮টি রিট
-
২০২১ সালে ৫৬৯টি রিট
অন্যদিকে রিহ্যাব জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের কাছে জমা পড়েছে ৩৪০টি প্রতারণার অভিযোগ, যেখানে ক্রেতাদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন,
“যে সব প্রকল্প বন্ধক রাখা হয়, ব্যাংকের আইনে সাইনবোর্ড ঝুলানোর কথা। কিন্তু অনেক সময় ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে তা করা হয় না। ফলে ক্রেতারা কিছু না জেনেই বিপদে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, একজন সাধারণ ক্রেতার পক্ষে প্রতিটি ব্যাংক ঘুরে তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়। তাই বন্ধকী সম্পত্তির সাইনবোর্ড বাধ্যতামূলকভাবে দৃশ্যমান করা উচিত এবং সরকারের উচিত একটি ডিজিটাল ডেটাবেস তৈরি করা, যেখানে যে কেউ সহজে দেখতে পারবেন কোন সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আছে।
উত্তরার ‘ব্রাইট সাউথ’ প্রকল্পে দেড় কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন ডা. রফিকুল বারী। এক বছর নির্ভয়ে পরিবার নিয়ে বসবাসের পর একদিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দেখেন, তাদের ভবনের সামনে ঝুলছে সোনালী ব্যাংকের নিলাম নোটিশ।
ব্যাংক দাবি করেছে, ভবনটির মালিক প্রতিষ্ঠান ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং ৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ করেছে।
রফিকুল বারী বলেন,
“ডেভেলপার আমাকে শুধু অস্থায়ী দলিল দিয়েছিল, আসল দলিল দেয়নি। পরে জানতে পারি ভবনটি ২০১২ সালেই ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল।”
তিনি হাইকোর্টে রিট করেন এবং মানবিক কারণে আদালত আপাতত নিলাম স্থগিত রাখে।
তদন্তে জানা গেছে, কোম্পানির চেয়ারম্যান আখতার হোসেন সোহেল রাজধানীর আরও সাতটি প্রকল্পে একই কৌশলে প্রতারণা করেছেন, এবং ৪০০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
রামপুরার রাফিউর রহমান ২০২০ সালে ঝলক হাউজিং–এর একটি প্রকল্পে ফ্ল্যাট কেনেন। পরে জানতে পারেন, সেই ফ্ল্যাটও ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা ছিল। কোম্পানির ৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপির পর আদালত রায় দেয় ব্যাংকের পক্ষে, এবং ফ্ল্যাটগুলো নিলামে তোলে।
দরদাতা না পাওয়ায় ফ্ল্যাটগুলো ব্যাংক নিজেদের দখলে নেয়।
রাফিউর রহমান বলেন,
“এখন আমি আমার নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকি, কিন্তু ব্যাংককে মাসে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। আমার তিন প্রতিবেশী ইতোমধ্যে চলে গেছেন। এটা অপমানজনক, হৃদয়বিদারক।”
তিনি প্রতারণার মামলা করেছেন, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে তা কেউ জানে না।
সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান বলেন,
“ব্যাংক শুধু তার ঋণ উদ্ধারের আইনি পথেই হাঁটে। কোনো কোম্পানি প্রতারণা করলে সেটা তাদের দায়, ব্যাংকের নয়।”
অন্যদিকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান স্বীকার করেন, ব্যাংকেরও কিছু দায়িত্ব আছে—
“বন্ধকী সাইনবোর্ড ঝুলানো বাধ্যতামূলক। অনেক সময় তা পর্যবেক্ষণ করা হয় না, ফলে গ্রাহকরা প্রতারিত হন।”
রিহ্যাবের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ বলেন,
“আবাসন খাতে প্রতারণা ঠেকাতে সরকারের কার্যকর সেল বা নজরদারি ইউনিট নেই। ফলে অনেক সময় প্রভাবশালী ডেভেলপাররা পার পেয়ে যায়।”
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল ও জরিমানা করা হয়। কিন্তু অনেক ক্রেতা বলেন, এসব পদক্ষেপ “কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।”
ঢাকায় এখন যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা কেবল আর্থিক প্রতারণা নয়—এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও স্বপ্নে আঘাত। যাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ফ্ল্যাট, তারা আজ আদালতের দোরগোড়ায় ঘুরছেন, নিজের ঘরেই ভাড়াটিয়া হয়ে বেঁচে আছেন।
এই সংকটের স্থায়ী সমাধান না হলে—‘নিজের ঘর’ হয়তো আগামী দিনে ঢাকাবাসীর কাছে আর নিরাপত্তার প্রতীক থাকবে না, বরং এক নতুন ভয়াবহতার নাম হয়ে উঠবে।

