নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাসিন্দা আইয়ুব আলী একসময় রিকশা চালাতেন। এখন শারীরিক সমস্যার কারণে আর তা করতে পারেন না। বাড়ির কাছে হকারি করে কিছু আয় করার চেষ্টা করছেন, তবুও সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করছেন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু সব চেষ্টার পরও তারা পাননি স্বল্পমূল্যের পণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড। শুধু আইয়ুব আলীই নন, এমন দেড় কোটি দরিদ্র মানুষ এখনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত, কারণ বাতিল হওয়া সাড়ে ৩৮ লাখ ফ্যামিলি কার্ড এখনো বিতরণ হয়নি।
আইয়ুব আলী বলেন, “টিসিবি প্রথম ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ শুরু করার সময় আমি একটি কার্ডের জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু পাইনি। আগের সরকারের সময় নেতা-মেম্বারদের পিছে ঘুরেও কোনো ফল হয়নি। এখন মেম্বার-চেয়ারম্যানও নেই, আর কার কাছে যাবো? নেতারা তো নিজেদের লোকদের কার্ড বানাতেই ব্যস্ত।”
২০২২ সালে টিসিবি পণ্য বিক্রির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এবং প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিত করার জন্য ফ্যামিলি কার্ড ব্যবস্থা চালু করে। লক্ষ্য ছিল এক কোটি পরিবারকে কার্ডের আওতায় আনা। প্রথম বছরের মধ্যে এক কোটি পরিবারকে সরাসরি কার্ড দেওয়া হয়। প্রতিটি কার্ডের বিপরীতে চারজন করে মানুষ উপকারভোগী হিসেবে গণনা করা হয়েছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এসব কার্ড যাচাই-বাছাই করে। ২০২৩ সালের নভেম্বরের শুরুতে ৫৭ লাখ কার্ড স্মার্টকার্ডে রূপান্তরিত হয়। বাকি ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করে স্থানীয় সরকার থেকে পুনরায় তথ্য চাওয়া হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৫৭ লাখ কার্ডের বিপরীতে পণ্য বিতরণ শুরু হয়।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে ৬১ লাখ ৫১ হাজার ২৩২টি সক্রিয়, বাকি ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার কার্ড এখনও অকার্যকর। প্রতিটি কার্ডের চারজন হিসাব করলে, দেড় কোটি দরিদ্র মানুষ এখনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
পিপিআরসি’র সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের দারিদ্র্য হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। অর্থাৎ তখন ৩ কোটি ১৭ লাখ মানুষ দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশে, দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি। টিসিবির পণ্য পাচ্ছে মাত্র ২ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ। ফলে ১ কোটি ৫৩ লাখ মানুষ সরকারের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
টিসিবি বলছে, একই পরিবারের দুইটি কার্ড থাকা, একই ফোন নম্বরে একাধিক কার্ড, মৃত ব্যক্তির নামের কার্ড ইত্যাদি কারণে কার্ড বাতিল করা হয়। স্মার্টকার্ড বিতরণের পরও অনেকে কার্ড অ্যাকটিভ করেননি, তাই বাতিল করা হয়েছে।
টিসিবির মুখপাত্র মো. শাহাদত হোসেন জানান, “বাতিল কার্ড প্রতিস্থাপনে ধীরগতির মূল কারণ স্থানীয় সরকার থেকে তথ্য পাওয়ায় দেরি হচ্ছে। উপজেলা, জেলা বা সিটি করপোরেশন থেকে নাম, ফোন নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য এলে আমরা দ্রুত কার্ড প্রিন্ট করে বিতরণ করতে পারি।” তিনি আশা করেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি কার্ডগুলো বিতরণ শেষ হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস. এম. নাজের হোসাইন বলেন, “টিসিবি দায়সারা কাজ করছে। স্থানীয় সরকারকে চাপ দিয়ে ঠিকভাবে মনিটরিং করলে এতদিনে কার্ড বিতরণ হয়ে যেত। এই কার্ডগুলো বিতরণ হলে বাজারের এই দুর্মূল্যে দেড় কোটি মানুষ স্বস্তি পেত।”

