সরকার দেশের বাজারে পাটের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাঁচা পাট রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে দুই মাস পার হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। উল্টো, ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা মতো প্রিমিয়াম মানের পাটের দাম বেড়েছে। মাঝারি মানের পাটের দাম কিছুটা কমলেও এখনও উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এটি দেখাচ্ছে রপ্তানি সীমার প্রভাব সীমিত।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা পাট রপ্তানি সীমিত করেছে। এখন রপ্তানি করতে হলে অনুমোদন নিতে হয়। পদক্ষেপটির লক্ষ্য ছিল দেশীয় মিলগুলো যাতে যুক্তিসঙ্গত দামে পর্যাপ্ত পাট পায় এবং পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ জানান, উচ্চমানের পাট সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে প্রতি মণ চার হাজার টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে দাম প্রায় চার হাজার ৩০০ টাকায় পৌঁছেছে।
ফরিদপুর জেলার কৃষকরা দেশের সর্বাধিক পাট উৎপাদন করে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রিমিয়াম মানের পাট এখন প্রতি মণ চার হাজার থেকে চার হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রপ্তানি সীমা আরোপের আগে দাম ছিল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা কম। ফরিদপুর বছরে প্রায় ২.১৪ লাখ টন প্রিমিয়াম পাট উৎপাদন করে, যা দেশের উচ্চমানের পাটের প্রধান উৎস।
ফরিদপুরের কানাইপুর বাজারের ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান চাঁন বলেন, “সরকার রপ্তানি সীমিত করেছে, তবুও বাজারে দাম কমছে না।”
কম উৎপাদন, সীমিত সরবরাহ
কর্মকর্তারা জানান, এ বছর পাট উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাট উৎপাদন ৬.৫ শতাংশ কমে ৮৯.৫ লাখ বেল হয়েছে। কম চাষ ও প্রতিকূল আবহাওয়া এ পরিস্থিতির কারণ।
ফরিদপুর ডিএএমের সিনিয়র মার্কেট অফিসার শাহাদাত হোসেন বলেন, “উৎপাদন কম, সরবরাহ সীমিত। চাহিদা স্বাভাবিক থাকলেও দাম কমেনি। রপ্তানি সীমা দিলেও বাজার স্থিতিশীল হয়নি। অনেক কৃষক দাম কমবে ভেবে আগেই পাট বিক্রি করেছেন।”
নগরকান্দা উপজেলার জুঙ্গুরদী গ্রামের কৃষক আনোয়ার মোল্লা জানান, “রপ্তানি সীমার কারণে আমরা দ্রুত পাট বিক্রি করেছি। এখন দেখি দাম বাড়ছে। সীমা না থাকলে আরও ভালো দাম পেতাম।”
ফরিদপুর জেলা পাট চাষি সমিতির সভাপতি মোক্তার মোল্লা বলেন, “এক বিঘা জমিতে পাট চাষে ৪০–৪২ হাজার টাকা খরচ হয়। এবার প্রতি বিঘায় মাত্র ৫–৬ মণ পেয়েছি। শ্রমিকের মজুরি দেওয়ার পর অনেকেই খরচ তুলতে পারছেন না। আগেই পাট বিক্রি করেছেন, এখন দেখছি দাম বাড়ছে।”
মাঝারি মানের পাট, যা বস্তা, হেসিয়ান ও প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়, তার দাম সামান্য কমে ৩৬০০–৩৭০০ টাকায় নেমেছে। আগে দাম ছিল প্রায় ৩৯০০ টাকা। ফরিদপুর পাট বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. ওমর ফারুক তালুকদার বলেন, “উচ্চমানের পাট রপ্তানিমুখী সুতা কারখানায় যায়, আর মাঝারি মানের পাট দেশীয় চাহিদা মেটায়। তাই দাম পার্থক্য স্বাভাবিক।”
মজুতদারি ও বাজার চাপ
কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়ার পিছনে মজুতদারদের দোষারোপ করছেন। ফরহাদ আহমেদ বলেন, “মজুদদাররা বিপুল পরিমাণ পাট কিনে রাখেন। পরে বেশি দামে মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।”
ফরিদপুর পাট বিভাগের সহকারী পরিচালক জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এক মাসের বেশি সময় এক হাজার মণের বেশি পাট মজুত করলে, তাকে মজুতদার হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে জনবল কম থাকায় সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “উৎপাদন কম, চাহিদা রয়েছে। রপ্তানি সীমা না থাকলে দাম ৫৫৫০ টাকায় পৌঁছাত, যা অস্থিতিশীলতা তৈরি করত।”
রপ্তানি সীমার পর কাঁচা পাট রপ্তানি কমেছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জুলাই–অক্টোবর সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের সম্মিলিত রপ্তানি ৪.৭ শতাংশ বেড়ে ২৭৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি মূলত সুতা, দড়ি, বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানির কারণে। কাঁচা পাট রপ্তানি তুলনামূলক কম ছিল। এর আগের অর্থবছরে (২০২৪–২৫) রপ্তানি নেমে এসেছিল ৮২০ মিলিয়ন ডলারে, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
মাগুরা সদর উপজেলার রাওতারা গ্রামের কৃষক নব কুমার কুণ্ড বলেন, “মূলত উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। আমরা এমন দাম চাই যা পাট চাষে উৎসাহ দেবে। তবে সরকারকে বাজারের স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে।”

