সরকারি উদ্যোগে প্রবাসী আয় বাড়ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এটি আগের বছরগুলোর তুলনায় স্পষ্টভাবে ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমেছে। ডলারের কৃত্রিম সংকটও কিছুটা শিথিল হয়েছে।
তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। হুন্ডি ও জাল নোটের আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি নিয়ে কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এতে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন নির্বাচন ঘিরে প্রবাসী আয় বাড়া স্বাভাবিক। তবে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সক্রিয়তা বৈধ চ্যানেল দুর্বল করতে পারে। কিছু জায়গায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর চেষ্টা বেড়েছে। এতে দেশের আর্থিক চ্যানেলগুলোকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি কড়া নজরে রাখছে।
বাজারে জাল নোট ছড়ানোর আশঙ্কাও রয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে কিছু মহল জাল নোট ব্যবহার করতে পারে। ভোটারদের বিভ্রান্ত করতেও এমন নোট কাজে লাগানো হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো জাল নোট ও হুন্ডি রোধে নিয়মিত মনিটরিং চালাচ্ছে। একাধিক সংস্থার যৌথ বৈঠকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সীমান্ত ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হবে। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিশেষ পরিদর্শন বাড়ানো হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মাসভিত্তিক প্রবাসী আয় ছিল যথাক্রমে — জুলাইয়ে ২৪৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, আগস্টে ২৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৬৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলার এবং অক্টোবরে ২৫৬ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার (২.৫৬ বিলিয়ন ডলার)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মার্চে রেমিট্যান্স প্রবাহ সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। ওই বছর পুরো অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়ায় ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স ছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। তথ্যগুলোর আলোয় এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি। রেমিট্যান্সের ধারাবাহিকতা রক্ষা না হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই হুন্ডি ও জাল নোট রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় ক্যাশলেস পদ্ধতি জোরদার করতে বলা হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বড় লেনদেন করতে জনগণকে উৎসাহিত করা হবে। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার হলে জাল নোট প্রবেশের ঝুকি কমবে বলেও বলা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। কখনো প্রার্থীরাও ভোটারদের কাছে নগদ পৌঁছে দিতে পারেন। তাই রেমিট্যান্সকে বৈধ পথে টানতে হবে। হুন্ডি চক্র দুর্বল করতে হবে এবং জাল নোট প্রবেশ রোধ করতে হবে। ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দাম প্রায় সমান থাকায় প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। এটা ভালো লক্ষণ।
তিনি আরও বলেন, অবস্থা বজায় রাখতে প্রচার ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। বড় লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করতে জোর দেওয়া প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোকে নির্বাচনের সময় অস্বাভাবিক লেনদেন শনাক্ত করে রিপোর্ট করার কঠোর নির্দেশ থাকা উচিত। এসবেই জাল নোট ছড়ানো ও অবৈধ লেনদেন রোধ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আমরা প্রবাসীদের সচেতন করতে কাজ করছি। ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের ডলারের বাজার মূল্য স্থিতিশীল। তাই হুন্ডির প্রসার বাড়বে না বলে আশা করছি। হুন্ডি পুরোপুরি বন্ধ করা কঠিন হলেও এটি কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে বড় আর্থিক লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করুন। জমি বা বাড়ি কেনার মতো লেনদেন ব্যাংকিংয়ের নথিভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইনফরমাল রেমিট্যান্স বা হুন্ডি চ্যানেলে পাওয়া অর্থ যদি সরকারি রেকর্ডে না আসে, তা অবৈধ বিবেচিত হতে পারে। এতে ব্যক্তিগত এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আরিফ হোসেন খান বলেন, একসময় বাজারে দুই লাখ কোটি টাকার জাল নোট সীমান্ত দিয়ে ঢুকবেন— এমন গুঞ্জন ছিল। এমন বিপুল পরিমাণ দ্রুতভাবে প্রবেশ করবে—এটি বাস্তবসম্মত নয়। তবু নির্বাচনি প্রেক্ষাপটে জাল নোট ছড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করা হতে পারে। সীমান্ত দিয়েই জাল নোট আনার চেষ্টা বেশি হয়। ঢাকাতেও নকল নোট ছাপানো হতে পারে, তাই সবখানে নজরদারি রেখেছি। জাল নোট সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি সমন্বিত গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। এই গ্রুপ সীমান্ত, বাণিজ্যকেন্দ্র ও শহর এলাকা পর্যবেক্ষণ করবে। দ্রুত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ যোগাযোগমাধ্যম চালু করা হবে। এতে নজরদারি ও প্রতিক্রিয়া দ্রুত হবে।
ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। সীমান্ত ও ট্রেডিং হাবগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে জনগণকে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। এতে জাল নোট প্রবেশের ঝুঁকি কমবে এবং রেমিট্যান্স বৈধ পথে আসবে।
প্রবাসী আয় বাড়ার ধারা দেশের জন্য ইতিবাচক। তবু নির্বাচনের আগে হুন্ডি ও জাল নোটের ঝুঁকি উজ্জ্বল ভাবেই আছে। সরকারের, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি যাতে রেমিট্যান্স বৈধ পথে বড় পরিমাণে আসে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

