২০২৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখা বঙ্গোপসাগরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলবর্তী মানুষজন সতর্কদৃষ্টি দিয়ে দুর্যোগের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ এই ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজারের এক অঞ্চলে আঘাত হানল, যেখানে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছিল।
গভীর রাতে স্থানীয়রা সাক্ষী হলেন ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার। স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন আলম বলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হঠাৎ সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল, আকাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। তীব্র বাতাস কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিনের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেল। মানুষ পরিবারসহ আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছালেও পুরো গ্রাম ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল। প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো। ৩০ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেল। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর নাজুক আশ্রয়ও প্রবল বৃষ্টি ও ধ্বংসাবশেষে ছিন্নভিন্ন হলো। ঘূর্ণিঝড় মোখা প্রমাণ করে দিল, বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু সংকট ভবিষ্যতের হুমকি নয়—এটি একটি চলমান বাস্তবতা।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করছে। এর প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ২০২২ সালে সিলেট এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়, যা প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছিল। ২০২৩ সালে ঢাকা ও পাবনায় তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ায় শহরগুলো রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহে পুড়ে যাচ্ছিল।
দেশের অবকাঠামো, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যব্যবস্থা মারাত্মক চাপে রয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়েছে। শহরে জলবায়ু অভিবাসীদের আগমনে পানি, বাসস্থান ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। ২০২৩ সালের ডেঙ্গু মহামারি ১ হাজার ৬০০-এর বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে। এটি দেখিয়েছে কীভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ইতিমধ্যেই প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ প্রতি বছর নিজস্ব বাজেট থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পরিবারগুলোও নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, যা বিদেশি সহায়তার তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে ৮০০-এর বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, বিদেশি অর্থায়ন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। দেশের অভিযোজন ও অন্যান্য জলবায়ু প্রকল্পের জন্য বছরে প্রয়োজনীয় ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশই পাওয়া যায়। এর বেশিরভাগই ঋণ হিসেবে আসে, যা অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। COP27-এ অনুমোদিত ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল’ কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। তবে প্রতিশ্রুত অর্থ এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। আসন্ন COP সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থায়নে সহজ প্রবেশাধিকার, অনুদানভিত্তিক সহায়তা এবং অর্থ বণ্টনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির দাবি তুলছে।
এই COP সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে বাংলাদেশ সেখানে দাবি করবে—‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল’-এর কার্যকর বাস্তবায়ন, দ্রুত তহবিল বিতরণ চ্যানেল নিশ্চিতকরণ এবং ধনী দেশগুলোর অপূর্ণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু অর্থায়ন বাস্তবায়ন।
অভিযোজনের পাশাপাশি, পুনরুদ্ধার ও সহনশীলতা প্রকল্পেও বাংলাদেশের ন্যায্য অংশ থাকা উচিত। বিশেষ করে যেসব দেশ ঘন ঘন জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। COP-এ বাংলাদেশ আরও সহজে ‘Green Climate Fund’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিলের অ্যাকসেস দাবি করবে, যা বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধীরগতির।
একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গঠনে বিনিয়োগ প্রয়োজন—লবণসহিষ্ণু ফসল, উঁচু ঘরবাড়ি, বন্যা-সহনশীল অবকাঠামো এবং টেকসই নগর পরিকল্পনা। শাসন ব্যবস্থার সংস্কারও জরুরি, যেন জলবায়ু তহবিল বাস্তব ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছে পৌঁছায়, বিশেষত নারী কৃষক ও বাস্তুচ্যুতদের কাছে। স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন কর্মসূচি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেতে হবে। প্রধান দূষণকারী দেশগুলোকে তাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল’ দ্রুত চালু করা না হলে বাংলাদেশের মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার বিপন্ন হবে। পদক্ষেপ নেওয়া দরকার—এখনই।
বাংলাদেশকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, কৃষি সহ সব জাতীয় পরিকল্পনায় জলবায়ু সহনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর জন্য দরকার স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং স্বচ্ছ জলবায়ু বাজেটিং। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও জোর দিতে হবে—জলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তি, টেকসই নগর উন্নয়ন এবং প্রতিবেশ পুনর্গঠন। উন্নত দেশগুলোকে কথার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়োপযোগী, যথাযথ এবং ন্যায্য জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এটি প্রয়োজন—অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধার উভয়ের জন্য।
বাংলাদেশিরা উদ্ধার পাওয়ার অপেক্ষায় নেই। আমরা উদ্ভাবনী, আমরা অভিযোজিত। কিন্তু আমাদের একা লড়াই করা উচিত নয়। আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশে যা ঘটবে, তা হবে বিশ্বের জলবায়ু ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। এখানে যদি ব্যর্থ হই, তবে ব্যর্থতা ছড়াবে সর্বত্র। পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।

