গ্রামীণফোনের নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটররা বিটিআরসির কাছে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অডিট বিরোধ আদালতের বাইরে সমাধানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে এই প্রক্রিয়ায় তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, এটি এক দশকের পুরনো কর্পোরেট বিরোধের সমাধান হতে পারে।
প্রথমবারের মতো সরকার এবং বিটিআরসির পক্ষ থেকে প্রস্তাবে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। বিটিআরসির সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে আদালতের বাইরে বিষয়টি এখন সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন। প্রায় এক দশকের আইনি স্থবিরতার পর এটি পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানের আশা জাগাচ্ছে।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী বলেন, “এই অচলাবস্থা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা শিল্পের কারো জন্যই লাভজনক নয়। আমরাও সমাধান চাই। আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায় কিনা তা আমরা যাচাই করছি। আমাদের প্যানেল আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করা হচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ বিকল্পও যাচাই করা হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনাও শুরু হয়েছে। রবি এবং বাংলালিংক — যাদের বিরুদ্ধেও একই রকম কিন্তু তুলনামূলক ছোট আকারের অডিট দাবি রয়েছে — ঘনিষ্ঠভাবে এই প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ এটি টেলিকম খাতে বড় ধরনের বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

এক দশকের পুরনো দ্বন্দ্ব:
বিরোধের শুরু ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিটিআরসির বিস্তৃত অডিট থেকে। আইন অনুযায়ী বার্ষিক অডিট না করে ২০১৭ সালে একযোগে অডিট শুরু হয়। ২০১৯ সালে বিটিআরসি গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে ১২,৫৭৯ কোটি টাকা, রবির বিরুদ্ধে ৮৬৭ কোটি টাকা এবং বাংলালিংকের বিরুদ্ধে প্রায় ৮২৩ কোটি টাকার দাবি উত্থাপন করে। মোবাইল অপারেটররা এই দাবি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের যুক্তি, অডিটের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ, কর্তৃত্ব সীমার বাইরে এবং সুদের হিসাব অযৌক্তিকভাবে বেশি। তবে বিটিআরসি বলছে, এই টাকা সরকারের রাজস্ব, তাই তা সরকারকে ফেরত দেওয়াই ন্যায্য।
সালিশির পথে অপারেটররা:
২০২৫ সালের ২৯ জুলাই গ্রামীণফোন আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে প্রস্তাব দেয়। তারা চায়, বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সালিশি করে এই অচলাবস্থা সমাধান করা হোক। কয়েক দিন পর রবি একই ধরনের অনুরোধ জানায়।
গ্রামীণফোন জানিয়েছে, তাদের মামলা — ২০১৯ সালের টাইটেল সুইট নং ৭১০ — প্রায় ছয় বছর ধরে আদালতে অগ্রগতি ছাড়াই ঝুলে আছে। তাই তারা যুক্তি দেখিয়েছে যে, অডিট বিরোধের জটিলতা বিবেচনা করে সালিশি পদ্ধতি দ্রুত এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারবে।
গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, “গ্রামীণফোন সবসময় দায়িত্বশীল ও কমপ্লায়েন্ট অপারেটর হিসেবে কাজ করেছে। ১২,৫৭৯ কোটি টাকার অডিট দাবির মধ্যে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায়, যা বিটিআরসির এখতিয়ারের বাইরে। আর প্রায় ৬,২০০ কোটি টাকা শুধুই সুদ। কাঠামোবদ্ধ সালিশি প্রক্রিয়া এই বিরোধের সমাপ্তি টানতে পারে। এটি সেক্টরে আস্থা ফিরিয়ে আনতেও সক্ষম।”
রবির চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, “অমীমাংসিত এই বিরোধ আমাদের ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান ও কাস্টমার সার্ভিস—উভয়কেই প্রভাবিত করছে। আমরা যেকোনো স্বচ্ছ, সময়োপযোগী এবং বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি।”
বিটিআরসির অবস্থান বদল:
দীর্ঘদিন ধরে বিটিআরসি সালিশিকে নিষিদ্ধ মনে করে দাবি করে আসছিল যে, টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী সালিশির কোনো সুযোগ নেই। তবে সম্প্রতি সংস্থাটির অবস্থানে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। বিটিআরসির এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “বিদ্যমান আইনে সালিশির সরাসরি বিধান নেই, কিন্তু আমরা সম্ভাব্য উপায়গুলো খতিয়ে দেখছি। অনাদায়ী টাকার ওপর সুদ বাড়ছে, যা সব পক্ষের জন্য ক্ষতিকর।” তবুও কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই অর্থ প্রকৃতপক্ষে সরকারের রাজস্বের অংশ। কর্মকর্তা জানান, “এই অর্থ জনগণের কাছ থেকেই সংগৃহীত হয়েছে, সুতরাং তা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়া উচিত।”
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, সরকার এই অচলাবস্থা দূর করতে সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতা করছে। তিনি বলেন, “লাইসেন্স নিয়ে যারা টেলিকম ব্যবসা করছে, তাদের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ সালিশি প্রক্রিয়া এটি করতে পারে। গ্রামীণফোন তাদের উদ্বেগ বিস্তারিত জানিয়েছে। সরকারও চাইছে একটি উইন-উইন সমাধান।”
ফয়েজ তৈয়্যব আরও জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অডিট প্রক্রিয়ার পুনর্গঠন পরিকল্পনা করছে। এতে ভবিষ্যতে নিয়মিত বার্ষিক অডিট হবে। এভাবে এক দশক পুরনো অর্থদাবি কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি স্বীকার করেছেন, আগের সরকারের সময় বিদেশি অপারেটরদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব একটি পক্ষপাতমূলক ধারণা তৈরি করেছিল। একই সময়ে শিল্পের কিছু লোকাল সেগমেন্ট — যেমন আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) এবং আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) — তুলনামূলকভাবে কম নজরদারিতে ছিল। আইজিডব্লিউ আন্তর্জাতিক ভয়েস কল এবং আইআইজি আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ট্রাফিক পরিচালনা করে।
অডিট নিয়ে বিতর্কের পটভূমি ও মূল বিষয়গুলো:
টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের সূত্রপাত হয় বিশাল অডিট প্রক্রিয়া থেকে, যা ঘটনার বহু বছর পরে সম্পন্ন হয়। আইন অনুযায়ী প্রতিবছর অডিট করার বিধান থাকলেও, বিটিআরসি ২০১৭ সালে মোবাইল অপারেটরদের হিসাব পর্যালোচনা শুরু করে। এই অডিট ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করে।
গ্রামীণফোনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিটিআরসির মোট ১২,৫৭৯ কোটি টাকার দাবির মধ্যে ৮,৪৯৪ কোটি টাকা বিটিআরসির কাছে (যার মধ্যে ৬,১৯৪ কোটি টাকা সুদ) এবং ৪,০৮৫ কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এপর্যন্ত গ্রামীণফোন পরিশোধ করেছে ২,৩৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২,০০০ কোটি এবং ২জি লাইসেন্স ফি সংক্রান্ত রায়ে ৩৯২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। রবির ওপর ৮৬৭ কোটি টাকার পৃথক বকেয়া দাবি রয়েছে। ২০২০ সালে হাইকোর্ট কোম্পানিকে ১৩৮ কোটি টাকা কিস্তিতে পরিশোধের নির্দেশ দেয়। বাংলালিংকের কাছে বকেয়া দাবি প্রায় ৮২৩ কোটি টাকা। কোম্পানিটি এর কিছু অংশ ইতিমধ্যেই পরিশোধ করেছে। তবে কিছু অংশের হিসাব নিয়ে তারা আপত্তি জানিয়েছে।
অপারেটররা অভিযোগ করেছে, বিটিআরসি অডিটে এনবিআরের কাছে বকেয়া রাজস্বকেও যুক্ত করেছে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখতিয়ারের বাইরে। তারা যৌগিক সুদ আরোপ এবং অনাপত্তি সনদ (এনওসি) স্থগিতকরণকেও জোরপূর্বক আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশে সালিশির বৈশ্বিক নজির:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি ও বিনিয়োগ খাতে বাংলাদেশে একাধিক হাই-প্রোফাইল সালিশি মামলা হয়েছে। এগুলো দেখায়, জটিল বাণিজ্যিক বিরোধও আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে মীমাংসা করা সম্ভব। সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণগুলোর একটি হলো নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেড বনাম পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স মামলা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি গ্যাসকূপ বিস্ফোরণজনিত ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে এটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি)-তে নেওয়া হয়।
একইভাবে, একটি মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (আইপিপি) নিয়ে বিরোধ আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে সালিশির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। আরেকটি উদাহরণ, অনুসন্ধানের চুক্তি কেন্দ্র করে বাপেক্স বনাম সোকার একিউএস এলএলসি (আজারবাইজানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ) মামলা। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আইন অনুযায়ী সালিশির মাধ্যমে সমাধান হয়। উৎপাদন খাতে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) কর্তৃপক্ষ ও জাপানি কোম্পানি মারুহিসা প্যাসিফিক-এর মধ্যে বিনিয়োগ বিরোধ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় সালিশিতে নিষ্পত্তি পায়। এটি দেখায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিরোধে সালিশি ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে পরিণত হচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে কোনো নির্দিষ্ট খাতে সালিশের সরাসরি আইনগত বিধান না থাকলেও, এটি একটি কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়। তারা আরও উল্লেখ করেন, পারস্পরিক সম্মতি এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্বিট্রেশন অ্যাক্ট-এর আওতায়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পক্ষই সালিশির মাধ্যমে দ্রুত, কম বৈরিতাপূর্ণ উপায়ে বিরোধ সমাধান করতে পারে।

