দেশে প্রথমবারের মতো মিঠাপানির মাছের মড়ক প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ টিকা কার্যকর হলে মাছের মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। প্রকল্পটি ময়মনসিংহসহ ১০ জেলায় পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এটি বাস্তবায়ন করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। দেশে উৎপাদিত মোট মাছের ৫৭ শতাংশ মিঠাপানিতে চাষ করা হয় কিন্তু কার্যকরী ভ্যাকসিনের অভাবে প্রতিবছর প্রচুর মাছ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ফলে মাছ চাষিরা বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চাষ করা মাছের মধ্যে ছোট মাছ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান আমিষের উৎস। মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই ছোট মাছ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিং, মাগুর, ট্যাংরা ও পাবদা মাছের চাষ সাম্প্রতিককালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব দেশীয় মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষের বড় সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু নতুন কিছু সংক্রামক রোগের বিস্তার দেখা দিয়েছে। প্রচলিত প্রতিকার পদ্ধতিতে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে চাষিরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
মাছের ভ্যাকসিন সাধারণত ইনজেকশন, ইমার্শন ও ওরাল পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে ইনজেকশন ও ইমার্শন পদ্ধতি সময় ও ব্যয় বেশি লাগে। তাই সহজ ও ব্যবহারযোগ্য ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা জরুরি, যা বড় খামার ও সব আকারের মাছের জন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। মাঠ পর্যায়ে মাছের ব্যাপক মড়কের কারণ অনুসন্ধান, রোগের প্রাদুর্ভাব ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ, বায়ো-মলিকুলার পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগজীবাণু চিহ্নিত করা এবং কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরি করলে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় শনাক্ত রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পটি ময়মনসিংহের ৮টি, টাঙ্গাইলের ৩টি, জামালপুরের ১টি, নেত্রকোনার ৩টি, কিশোরগঞ্জের ৩টি, গাজীপুরের ৩টি, যশোরের ৩টি, রংপুরের ২টি, নীলফামারীর ২টি ও বগুড়ার ৫টি উপজেলায় কার্যকর হবে। কারণ এসব এলাকায় পাবদা, ট্যাংরা, শিং, মাগুর, পাঙাশ, কৈ, তেলাপিয়া ও দেশি-বিদেশি কার্প জাতীয় মাছের চাষ অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নতুন রোগের বিস্তার মাছের মৃত্যুর হার বাড়িয়েছে এবং খামারিদের ক্ষতি তীব্রভাবে বৃদ্ধি করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশীয় মাছের নতুন রোগ প্রতিরোধে ৪৩ কোটি ৫১ লাখ টাকার ভ্যাকসিন প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে।
প্রকল্পের মূল কাজের মধ্যে রয়েছে ১৪২টি গবেষণা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা, যার খরচ ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। ১২টি গবেষণায় খরচ ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ১ হাজার ৩৯৮টি রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও গ্লাসওয়ারের জন্য ৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ৭৫৩ বর্গমিটার গবেষণাগার মেরামত করতে খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া ১৫টি যানবাহনের জন্য ১৫ লাখ, ৪৪টি আসবাবপত্রের জন্য ২ কোটি ১০ লাখ এবং ৭৬টি অফিস সরঞ্জামের জন্য ৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়া হবে ৬৫ লাখ এবং পিইসি ও পিআইসিসহ বিভিন্ন মিটিংয়ে সম্মানী হিসেবে ২২ লাখ টাকা খরচ হবে।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) গত ২ জুলাই সভা করে কিছু বিষয় সংশোধন করার নির্দেশ দেয়। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ৪ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। ৫০ কোটি টাকার কম খরচের কারণে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ৭ আগস্ট অনুমোদন দেন। প্রথা অনুযায়ী একনেক সভায় বিষয়টি জানানো হয়।
প্রকল্পের আওতায় আধুনিক বায়োমলিকুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের রোগজীবাণু শনাক্ত, বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ এবং লক্ষ্যভিত্তিক টিকা তৈরি করা হবে। মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এটি প্রয়োগে সহজ, খরচে সাশ্রয়ী এবং মাছের ওপর কোনো শারীরিক চাপ ফেলে না।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আল-আমিন জানান, “দেশীয় মাছের টেকসই উৎপাদন ধরে রাখতে এই প্রকল্প খুবই জরুরি। এটি কার্যকর হলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং মাছ চাষিরা উপকৃত হবেন। গবেষণায় সময় লাগে, তাই পরিকল্পনা কমিশন ৫ বছরের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।”

