দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর বেক্সিমকো টেক্সটাইলের অন্তর্ভুক্ত ১৫টি কারখানা আবার চালু হতে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, জাপানের রিভাইভাল গ্রুপ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইকোমিলি যৌথ উদ্যোগে বেক্সিমকো গ্রুপের সঙ্গে লিজ চুক্তি করতে যাচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার চুক্তির খসড়া জনতা ব্যাংকের বোর্ডে অনুমোদিত হওয়ার পর চূড়ান্ত স্বাক্ষর হবে। আর শ্রম উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি চুক্তিটি অনুমোদনের পর কারখানাগুলো চালু হবে।
প্রাথমিকভাবে রিভাইভাল ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এই অর্থ সরবরাহ করবে ইকোমিলি। কর্মকর্তারা বলছেন, কারখানা চালু হলে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারবেন। এর আগে ৮ অক্টোবর তিন পক্ষের মধ্যে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছিল। রিভাইভাল ও ইকোমিলি মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠান, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছেন। বেক্সিমকো টেক্সটাইল বন্ধ হওয়ার আগে জনতা ব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণদাতার কাছে এর ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের অংশ ছিল প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সব ঋণ এখনও শ্রেণিকৃত ঋণ হিসেবে রয়েছে।
চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, রিভাইভাল ১৫টি কারখানার বকেয়া ঋণের দায়ভার নেবে না। কারখানা চালু করতে নতুন ঋণ সুবিধা দেবে না জনতা ব্যাংক। চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন সরবরাহ করবে রিভাইভাল। উৎপাদিত পোশাক ও ফেব্রিকের রপ্তানি আয়ের ১.৫ থেকে ২.৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ হিসেবে নেবে রিভাইভাল। প্রাথমিকভাবে চুক্তির মেয়াদ ২ বছর ৪ মাস। পরে চাইলে মেয়াদ বাড়ানো যাবে। রপ্তানি আয়ের বাকি অংশ থেকে শ্রমিকদের মজুরি, ট্যাক্স ও পরিচালন ব্যয় মেটানো হবে। বাকি নিট মুনাফা পাবেন জনতা ব্যাংক। ব্যাংক এই অর্থ দিয়ে পুরনো ঋণ সমন্বয় এবং সরকারের দেওয়া ৫৮৫ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করবে। কারখানা চালু হওয়ার পর বেক্সিমকো গ্রুপ মুনাফা পাবে না।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ–বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, কারখানা চালু করার বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের সহযোগিতায় এগিয়েছে। রিভাইভালের সিইও হুদা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, “এটি শুধু কারখানা চালু করার উদ্যোগ নয়। হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার কাজ। প্রতিটি চাকরি নতুন আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।” ইকোমিলির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস. করিম বলেন, “এটি ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়, ব্রেইন গেইনের গল্প। প্রবাসীদের দক্ষতা দেশের শিল্পখাতকে শক্তিশালী করছে। আমরা একসাথে মানুষের জীবিকা ফিরিয়ে আনতে এবং শিল্পখাতকে নতুন প্রাণ দিতে চাই।”
বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, “সরকারের নির্দেশে বন্ধ হওয়ার আগে টেক্সটাইল বিভাগ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বে কাজ করেছে। ৪২ হাজার কর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি ও রপ্তানি রক্ষা করা ছিল মূল দায়িত্ব। আর্থিক সংকটের মধ্যেও যন্ত্রপাতি সচল রাখা হয়েছে। রিভাইভালের উদ্যোগে এখন কারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে।”
৫ আগস্টের পর বেক্সিমকোর সংকট ও বন্ধ কারখানা:
গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের কারখানাগুলোতে বেতন ও ভাতা বকেয়া পড়তে শুরু করে। অক্টোবর মাস থেকেই সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক আইনি পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে ছিল ব্যাংক হিসাব জব্দ, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অর্থপাচার ও ঋণ খেলাপি মামলার কার্যক্রম।
শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার তাদের দেনা-পাওনা পরিশোধ করে। সেই সময় অর্থ মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে বেক্সিমকোর নামে ৫৮৫ কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। এরপর কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের মোট কারখানার সংখ্যা ৩১টি। এর মধ্যে ১৫টি কারখানা চালু ছিল। নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই ১৫টি কারখানা আবার চালু হবে। বেক্সিমকো লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধন ৮৯৮.২৮ কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের শেয়ারের হার ৭.৮৯ শতাংশ।
বেক্সিমকো লিমিটেড ছাড়া অন্য ১৪টি কারখানার মধ্যে শুধু ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার এন্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডে তার মালিকানা রয়েছে। অন্য কোনো কারখানায় তার কোনো অংশ নেই বলে নিশ্চিত করেছেন বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে বেক্সিমকো টেক্সটাইল পুনরায় উৎপাদন শুরু করবে:
শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চুক্তির প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিলি ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে তা ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে। রিভাইভাল ও ইকোমিলির শীর্ষ কর্মকর্তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে উৎপাদন শুরু হলে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কারখানাগুলোতে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক পুনরায় কাজে ফিরবেন। রিভাইভাল আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করতে পারবে। এটি বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, “বেক্সিমকোর পুরোনো ঋণের দায়ভার নেবে না রিভাইভাল। ঋণ আপাতত ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখা হবে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে, যাতে আর সুদ যুক্ত না হয়। মঙ্গলবার ব্যাংকের বোর্ড চুক্তির খসড়া ও ঋণ ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করবে।”
তিনি জানান, “সরকার বেক্সিমকো টেক্সটাইল পুনরায় চালুর পেছনে প্রধান কারণ ছিল কারখানাগুলোতে উন্নতমানের মেশিন থাকা এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের উপস্থিতি। ফলে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে সরকার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানি রিভাইভালের সঙ্গে আলোচনা তারই অংশ।” লিজ চুক্তির মাধ্যমে কারখানা পুনরায় চালুর বিষয়ে সমন্বয় করছে শ্রম মন্ত্রণালয়। এটি ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অনুমোদিত হয়েছে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বিডা, রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কারখানা বন্ধ হওয়ার আগে যেসব বিদেশি ক্রেতার কাছে পোশাক রপ্তানি হতো, সেসব পুনরায় রপ্তানি করলে রিভাইভাল সার্ভিস চার্জ হিসেবে মোট রপ্তানির ১.৫ শতাংশ কমিশন পাবে। নতুন ব্র্যান্ডে রপ্তানি হলে চার্জ ২.৫ শতাংশ হবে। শ্রম মন্ত্রণালয় হিসাব অনুযায়ী, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কর-ভ্যাট, ঋণের সুদসহ সব খরচ বাদ দিয়ে ৪.৫ থেকে ৫ শতাংশ নিট মুনাফা করে।
রিভাইভাল শুধু কারখানা চালু করাই নয়, বাংলাদেশি টেক্সটাইল ও ফ্যাশন খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে চায়। তারা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে পুনঃসংযোগ করবে এবং নতুন বৈশ্বিক অংশীদার যুক্ত করবে। লক্ষ্য শুধু কম খরচে পোশাক উৎপাদন নয়, বরং বাংলাদেশকে সৃজনশীলতা ও ব্র্যান্ড উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। রিভাইভালের দর্শন—“স্থানীয় ডিজাইন, বৈশ্বিক বাজার” (Local Design, Sell Globally)—বাংলাদেশি পণ্যে নতুন উচ্চমান যোগ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে।

