ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার মাঝেও সরকার শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। গত সোমবার গেজেটে এটি প্রকাশিত হয়। অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদের ২৩ অক্টোবরের সভায় নীতিগত অনুমোদন পায়।
সরকারের আশা, নতুন নিয়ম শ্রমিকদের সংগঠন সহজ করবে এবং তাদের কর্মসংস্থান নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির বিধান পরিবর্তন করে সরকার নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিকের সম্মতি ভিত্তিক নিয়ম এনেছে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী:
- ২০ থেকে ৩০০ শ্রমিকের প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন গঠনে ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সম্মতি লাগবে।
- ৩০১ থেকে ৫০০ শ্রমিকের জন্য ৪০ জন,
- ৫০১ থেকে ১,৫০০ শ্রমিকের জন্য ১০০ জন,
- ১,৫০১ থেকে ৩,০০০ শ্রমিকের জন্য ৩০০ জন,
- ৩,০০১ বা তার বেশি শ্রমিকের প্রতিষ্ঠানে ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতি প্রয়োজন।
একটি প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচটি করা হয়েছে, যা আগে ছিল তিনটি। শ্রমিকদের সুরক্ষা আরও জোরদার করতে ভবিষ্যৎ তহবিলের বিধানও পরিবর্তিত হয়েছে। এ পর্যন্ত যা ঐচ্ছিক ছিল, এবার তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই মালিককে একটি ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করতে হবে। বিকল্প হিসেবে শ্রমিকরা চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রগতি’-তে অংশ নিতে পারবে। এতে শ্রমিক ও মালিক উভয়ই ৫০ শতাংশ চাঁদা দেবেন। তবে কোনো শ্রমিক স্কিমে থাকতে না চাইলে মালিকের অতিরিক্ত চাঁদা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো শ্রমিক বা ইউনিয়নের সদস্যের চাকরি শেষ হলেও তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না। তথ্যভান্ডার বা নোটিশের মাধ্যমে এ ধরনের তালিকা তৈরি করাও নিষিদ্ধ। মালিকপক্ষ কোনোভাবেই শ্রমিকদের প্রভাবিত করে ইউনিয়ন গঠন বা ভাঙার চেষ্টা করতে পারবে না।
এর আগে বিজিএমইএ কমপ্লেক্সের নুরুল কাদের অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অধ্যাদেশের কিছু বিধান, বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, দ্বৈত পেনশন স্কিম এবং শ্রমিক সংজ্ঞা দেশের বাস্তবতা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ধরনের ধারা কার্যকর হলে শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে, উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, পোশাকশিল্পসহ দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ’ অনুমোদন দিয়েছে। তবে টিসিসি ও ওয়ার্কিং কমিটিতে দীর্ঘ আলোচনার পর প্রস্তাবিত ধাপে ধাপে শ্রমিক সংখ্যা নির্ধারণের ভারসাম্যপূর্ণ প্রস্তাব পরে উপদেষ্টা পরিষদ একতরফাভাবে পরিবর্তন করেছে। তিনি সতর্ক করেছেন, ‘মাত্র ২০ শ্রমিক দিয়ে ইউনিয়ন গঠন হলে এমন ব্যক্তিরা ইউনিয়ন করবে যারা শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। এটি শিল্পে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিনিয়োগকারীর আস্থা কমবে এবং উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হবেন।’
২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে জানান, শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র কনভেনশনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনকে আধুনিক, আন্তর্জাতিক মানসম্মত এবং শ্রমিক-উদ্যোক্তা উভয়ের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ করার লক্ষ্যেই সংশোধনগুলো করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সংশোধিত শ্রম আইনে গৃহকর্মী ও নাবিকদের শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। ফলে তারা শ্রম আইনের সুরক্ষার আওতায় আসবেন। নন-প্রফিট সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও আইন কার্যকর হবে। শ্রমিকদের ব্ল্যাকলিস্টিং প্রথা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে।

