কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি স্পষ্ট দেখা যায় আশির দশকের পরবর্তী ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে। এসব দেশে বিদেশী বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, প্রযুক্তি স্থানান্তর ঘটিয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রেখেছে।
বাংলাদেশও বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। তবু দেশের বড় আকারের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এখনো সেভাবে সাফল্য আসেনি। এর পেছনে দায়ী আংশিকভাবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ নীতির ধারাবাহিকতার ঘাটতি, বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
সম্প্রতি বিদেশী বিনিয়োগের গতি আরও শ্লথ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উদ্যোগে বিদেশী বিনিয়োগ আনার প্রচেষ্টা স্বাগতযোগ্য। তবে যেকোনো কনসেশন চুক্তি চূড়ান্তের আগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এটি অনেক দিক থেকে ইতিবাচক। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের বন্দরের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে চুক্তির মূল বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। তাই বন্দরে বিদেশী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। চুক্তি সংশ্লিষ্ট অংশীজন এবং জনগণের মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) একই দিনে দুইটি বড় চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালে ২২ বছরের টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগ এবং লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে ৫০ বছরের কনসেশন চুক্তি। এই দুই চুক্তি ঘিরে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনুমোদন, এবং বোর্ডে সদস্য সংখ্যা সংকটের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুক্তি নেগোসিয়েশন এবং চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটির বেশির ভাগ সদস্যও অবগত ছিলেন না। কেবল চবক, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের কয়েকজন নির্বাচিত সদস্যই জানতেন। মূল্যায়ন কমিটিকে পাশ কাটানো, প্রয়োজনীয় বোর্ড সদস্য ছাড়া অনুমোদন নেয়া, একই দলের সদস্যদের একই সময়ে দুটি আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশনে জড়ানো এবং একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ফাইল পৌঁছে যাওয়া—সব মিলিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন তাড়াহুড়োর অভিযোগ উঠেছে।
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গিয়ে নীতি ও প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এতে বিনিয়োগের বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং জনস্বার্থ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর আগেও অনেক চুক্তি যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনেই নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ২০১৭ সালে ভারতের আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। চুক্তিটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে বা পরে জনসম্মুখে আনা হয়নি। দীর্ঘদিন এটি গোপন ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী শর্ত রয়েছে এবং আদানির পক্ষে এককভাবে সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চুক্তি থেকে বের হওয়ার কার্যকর কোনো আইনি সুযোগ বিপিডিবির কাছে নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের আমলে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প ও চুক্তি যাচাইয়ের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কারণ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশির ভাগ চুক্তিতে স্বচ্ছতা ছিল না। সে সময় জবাবদিহি ছাড়াই চুক্তি সই করা হয়। কিন্তু বড় হতাশাজনক বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকারও চুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারেনি। জবাবদিহি কার্যকর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে বলছেন, আদানির মতো চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নকেও একই ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি সম্পন্ন করা হচ্ছে। এসব চুক্তির খসড়া, বিশেষ করে গ্যারান্টি, ইনডেমনিটি, টার্মিনেশন এবং পরিবেশ সংক্রান্ত ধারাগুলো এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো প্রকাশ করা জরুরি ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের যেকোনো মালিকানা বা পরিচালনাসংক্রান্ত চুক্তি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাই চুক্তির সংবেদনশীল ধারা যাচাই-বাছাই, অংশীজনের মতামত এবং নানা ধরনের পর্যালোচনা করা দরকার।
কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনালের চুক্তির শর্ত ও অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট নীতিগত ঘোষণা নেই। সরকারি সূত্র তথ্য দিচ্ছে না, বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিচ্ছে না। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও চুক্তির সারসংক্ষেপ দেখতে পাননি। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, চুক্তিগুলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশী অপারেটর বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার পদ্ধতিতে টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার পাবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা আদৌ পুনরুদ্ধার করা যাবে কি না, নাকি দীর্ঘমেয়াদে অপারেটরেরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তা অনিশ্চিত। স্বচ্ছতার অভাবে ভবিষ্যতে বিদেশী বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বিশ্বে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে, তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। অথচ সরকার জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতি অনুসরণ করছে। চুক্তি ঘিরে অস্বচ্ছতা ও বিতর্ক বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ তৈরি করতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে তা আকৃষ্ট করার প্রয়োজনে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি এটি দেশের কাঠামোগত দুর্বলতা ও সুশাসনের ঘাটতিও প্রকাশ করে। অতএব যেকোনো সরকারেরই মনে রাখা প্রয়োজন—দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে সঠিক পথে রাখতে চাইলে যেকোনো চুক্তি অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে হওয়া প্রয়োজন।

