সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মূল বেতন করযোগ্য হওয়ায় মোট ৮২ শতাংশই আয়করের বাইরে চলে যাচ্ছে। একই কারণে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদেরও চাকরিতে যোগদানের প্রথম চার বছর আয়কর দিতে হয় না। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবীদের শুরু থেকেই পুরো বেতনের ওপর আয়কর কাটা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দ্বৈতনীতি স্পষ্ট বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও পেনশন দিতে সরকারের বছরে ব্যয় ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। যদি সরকারি কর্মচারীদের আয়করও বেসরকারি খাতের মতো পুরো বেতনের ওপর নির্ধারণ করা হতো, রাজস্ব আদায় অনেক বাড়ত। বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা সরকারকে মাত্র ১৬১ কোটি টাকা আয়কর দিচ্ছেন। গড়ে একজনের কর পরিশোধ মাত্র ৬ হাজার ২২১ টাকা। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, “কর ন্যায্যতার জন্য সব নাগরিকের ওপর একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিত। পেশাভেদে আলাদা সুবিধা দিলে রাজস্ব আদায় কমে এবং সমাজে বৈষম্য বাড়ে।”
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান বলেন, “প্রতিবছর বাজেটে সরকার নারী-পুরুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করে। পুরুষের জন্য ৩.৫ লাখ, নারীর জন্য ৪ লাখ টাকা। এটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেখানে সরকারি চাকরিজীবীর শুধু মূল বেতন করযোগ্য, সেখানে বেসরকারি পুরো বেতনের ওপর কর দেয়—এটি স্পষ্ট বৈষম্য।” তিনি আরও বলেন, “এই নীতির দ্বৈততার কারণে সরকারি চাকরিজীবীরা প্রিভিলেজড বা এলিট শ্রেণি হিসেবে দেখা হয়। সমাজে বৈষম্য কমাতে হলে সরকারি কর্মচারীদেরও বেসরকারি খাতের মতো কর দিতে হবে।”
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জিইএমএস তথ্য অনুযায়ী, সরকারে মোট অনুমোদিত পদ ১৯ লাখ ১৯ হাজার ১১১টি। বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৯১ জন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগীর সংখ্যা ৮ লাখ ৩৫ হাজার ১৫। এত বিপুলসংখ্যক কর্মচারীকে বেতন-ভাতা ও পেনশন দিতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে এনবিআর সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ভাতাকে করমুক্ত রাখার প্রজ্ঞাপন জারি করে। স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, বিজিবি, জুডিশিয়াল সার্ভিস ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২৩ সালে এনবিআর সব সরকারি কর্মচারীর জন্য আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করেছে। সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নির্দেশনা তাতে অন্তর্ভুক্ত।
সম্প্রতি এনবিআর জানিয়েছে, পুরুষ কর্মচারীদের মাসিক মূল বেতন ২৬,৭৮৫ টাকা এবং নারী কর্মচারীদের ৩০,৩৫৭ টাকার বেশি হলে উৎসে কর কাটতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বাসা ভাড়া, চিকিৎসা, যাতায়াত, মহার্ঘ্য, অব্যবহৃত ছুটি ভাতা, বোনাস ও যানবাহন ভাতা করমুক্ত। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের কর্মীরা মূল বেতন, বোনাস, বাড়িভাড়া ও যাতায়াত ভাতাসহ মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর কর দেন।
বিসিএস ক্যাডারে ৯ম গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের চার বছর (মহিলাদের ক্ষেত্রে ছয় বছর) কর দিতে হয় না। এনবিআরের তথ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীরা ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আয়কর দিয়েছেন। আয়কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি সামান্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১১ কোটি ৫৭ লাখ, ২০২১-২২-এ ১১৪ কোটি ৩ লাখ, ২০২২-২৩-এ ১২৫ কোটি ৭৫ লাখ এবং ২০২৩-২৪-এ ১৫০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কেবল ১৮ শতাংশই নিয়মিত আয়কর দিচ্ছেন।
জিইএমএসের তথ্য ও আয়কর আইন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৯ম গ্রেড ঊর্ধ্ব কর্মকর্তা মূলত কর দিচ্ছেন। বাকি নিচের সারির কর্মচারী শুধু রিটার্ন জমা দেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দুই বছর আগে সরকারি ভাতার ওপর কর আরোপের সুপারিশ করেছিল। তবে তখনকার প্রধানমন্ত্রী সেটি আইনভুক্ত না করার নির্দেশ দেন।

