দেশের বাজারে এখন ১০টির বেশি ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) বিক্রি হচ্ছে। তবে বিক্রির পরিমাণ এখনও কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বাধা হচ্ছে গাড়ির নিবন্ধন ফি ও অগ্রিম কর। বিশ্বের অনেক দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার বাড়াতে এসব ফি মওকুফ করা হয়। কিছু দেশে সরাসরি নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এসব সুবিধা নেই। এ-সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়া তৈরি হলেও তা এখনো পাস হয়নি।
দেশে গাড়ি চালাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের নিবন্ধন ফি জমা দিতে হয়। এই ফি গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষমতা বা সিসির ওপর নির্ধারিত হয়। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে ইঞ্জিন ক্ষমতা হিসাব করা হয় মোটরের শক্তির ওপর, যা কিলোওয়াটে মাপা হয়। দেশে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক গাড়ির মোটর ১০১ থেকে ১৬০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। এসব গাড়ির নিবন্ধন ফি দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৭ হাজার থেকে ৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
অগ্রিম করেও বৈষম্য দেখা যায়। জ্বালানিচালিত ১৫০০ সিসি গাড়ির জন্য অগ্রিম কর দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা, আর ২০০০ সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা। অথচ একই ক্ষমতার বৈদ্যুতিক গাড়িতে (১০০ থেকে ১৭৫ কিলোওয়াট) অগ্রিম কর দিতে হয় ২ লাখ টাকা। কারও একাধিক গাড়ি থাকলে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ টাকা। র্যানকন মোটরসের বিভাগীয় পরিচালক ইমরান জামান খান বলেন, প্রতিবেশী ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন ফি মাত্র ৬০০ রুপি, যা বাংলাদেশের ৮৪০ টাকার মতো। থাইল্যান্ডে ফি নেই। নেপালে দুই হাজার টাকার একটু বেশি ফি লাগে। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে নিবন্ধন ফি, প্রণোদনা ও অগ্রিম কর মওকুফের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রণোদনা থাকলে বিক্রয় বাড়তে পারে।
দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি এখনও সীমিত:
বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা এখনও খুবই কম। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ৪টি, ২০২২ সালে ২টি, ২০২৩ সালে ৩৮টি ও ২০২৪ সালে ৬৬টি বৈদ্যুতিক গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে। চলতি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২টি।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবেশী দেশগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রসারে অনেকটা এগিয়ে আছে। ভারত ২০১২ সালে বৈদ্যুতিক বাহন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে ভারতের মোট গাড়ির ২.৫ শতাংশই বৈদ্যুতিক। থাইল্যান্ড নীতিমালা করেছে ২০১৫ সালে, নেপাল ২০১৮ সালে ও শ্রীলঙ্কা ২০২৩ সালে। আজ সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়ির অংশ যথাক্রমে ২১.২ শতাংশ, ৭৬ শতাংশ এবং উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। অথচ বাংলাদেশে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা মাত্র ২১২। নীতিমালাও এখনো প্রণয়ন হয়নি।
বিওয়াইডি বাংলাদেশের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইমতিয়াজ নওশের বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত ৩৫০টির বেশি গাড়ি বিক্রি করেছি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ প্লাগইন হাইব্রিড, বাকি ৩০ শতাংশ সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক। মানুষের আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে নিবন্ধন ফি ও অগ্রিম কর বেশি হওয়ায় ক্রেতা কম।”
দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশন কম:
দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য বর্তমানে প্রায় ৪০টি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। এর অধিকাংশই ঢাকায়। ডিসি (ডিরেক্ট কারেন্ট) চার্জিং স্টেশন স্থাপনে খরচ লাগে ৬০ লাখ টাকা, আর এসি (অলটারনেটিং কারেন্ট) চার্জিং স্টেশন করতে লাগে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। তাই দেশে বেশি এসি চার্জিং স্টেশন তৈরি করা হয়। রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলেও চার্জিং স্টেশন স্থাপন সম্ভব।
ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলিউশন লিমিটেড ২০২২ সাল থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশন নিয়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত বেসরকারি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৫টি চার্জিং স্টেশন তৈরি করেছে। চলতি বছরের মধ্যে আরও ২০টি চার্জিং স্টেশন স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর শাহরিয়া বলেন, “চার্জিং স্টেশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ। দেশে এখনো চার্জিং স্টেশন থেকে আয় করার মতো বৈদ্যুতিক গাড়ি নেই। ২০৩০ সালের পর থেকে এই খাত থেকে বড় আয়ের সম্ভাবনা আছে। তাই শুরুতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। এতে বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়বে।”
প্রোগ্রেস মোটরস ইমপোর্টস লিমিটেডের কান্ট্রি লিড (বিপণন ও পরিচালন) তানজিলা তাসলিম বলেন, “অধিকাংশ ক্রেতা ভাবেন দেশে চার্জিং স্টেশনের সংখ্যা কম। তবে বাস্তবে সব বৈদ্যুতিক গাড়ির সঙ্গে একটি করে চার্জিং স্টেশন বা যন্ত্র দেওয়া হয়। তাই বাসাতেই গাড়ি চার্জ করা যায়।”
বাংলাদেশে ইভি শিল্প উন্নয়নের নতুন নীতিমালা তৈরি হচ্ছে:
বিশ্বের নতুন গাড়ির প্রায় ২০ শতাংশই এখন বৈদ্যুতিক। বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়াতে শিল্প মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে নতুন নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে। এতে নানা সুবিধা যুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নীতিমালার খসড়ায় বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে শুল্কহার ও নিবন্ধন ফি কমানো এবং ব্যাংক ঋণের সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ‘ইলেকট্রিক ভেহিকেল শিল্প উন্নয়ন’ শীর্ষক নীতিমালায় বলা হয়েছে, নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে গাড়ির মোট মূল্যের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে। ঋণের মেয়াদ হবে আট বছর।
নীতিমালায় ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি ও করপোরেট সংস্থার কেনা গাড়ির ৩০ শতাংশ বৈদ্যুতিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন, ট্যাক্স টোকেন ও ফিটনেস সনদ প্রদানে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) সম্পূর্ণ মওকুফ এবং নিবন্ধন ফি ৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
র্যানকন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রশিদ বলেন, “ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে রাজ্য সরকার ১৫ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় সরকার ৪০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়। কয়েক বছর প্রণোদনা প্রদানের পর এখন ভারতে মানুষ বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনছে। বাংলাদেশেও এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে করপোরেট ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা বাড়তে পারে।”

