২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে একই সময়ে ব্যয় কমেছে প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) গতকাল এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৮.৩৩ শতাংশে। গত বছর একই সময়ে হার ছিল ৭.৯০ শতাংশ। এ সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মোট ১৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তুলনামূলকভাবে, গত বছর একই সময়ে এই ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারের এডিপি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫.৬৪ কোটি টাকা।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, এডিপি বাস্তবায়নের গতি এখনও ধীর। সাধারণত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রায় ১২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। আইএমইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে জটিলতা, টেন্ডারে বিলম্ব, ঠিকাদারের অভাব এবং ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতার কারণে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। তারা আরও বলেন, গত বছরের জুলাই–আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সরকারের পরিবর্তনের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম প্রায় থমকে গিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এ বছর এডিপি বাস্তবায়নে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় পৌঁছায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বছরের শুরু থেকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক কারণে যেসব প্রকল্পের ঠিকাদাররা কাজ ফেলে চলে গিয়েছিল, সেগুলো এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। তাই বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ইতিহাসের সর্বনিম্ন। এ বছরও শুরুতে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে সরকার ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় আগামী জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের কাজ আরও শ্লথ হতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন কার্যক্রমে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা দেখায়, সাধারণত অর্থবছরের প্রথম দিকে বাস্তবায়ন হার কম থাকে। এবার নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত কার্যক্রম এ গতি আরও কমাবে। নতুন সরকার আসার পরও তাদের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ে সময় লাগবে। এ কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি কম থাকবে।”
উৎস অনুযায়ী এডিপি ব্যয়:
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরকারি তহবিল থেকে ১০ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি মোট বরাদ্দের ৭.৫১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছিল ১১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা বা ৭.১৫ শতাংশ। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৯.১৬ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে এটি ছিল ৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা বা ৮.২১ শতাংশ। সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা।
বিজ্ঞান, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে এডিপি বাস্তবায়ন:
চলতি অর্থবছরে মোট বাজেটের ৭৪ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এডিপি বাস্তবায়ন মূলত এদের ওপরই নির্ভর করছে। সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের বাস্তবায়ন হার ১.১৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের হার ১.৬১ শতাংশ। রেলপথ মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে বরাদ্দের ৪.৯২ শতাংশ। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে:
- সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৫.১৩ শতাংশ
- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫.৪৩ শতাংশ
- মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৭.৪১ শতাংশ
- নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ৭.৮৪ শতাংশ
- বিদ্যুৎ বিভাগ ৮.১৩ শতাংশ
সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২২.৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে শীর্ষে রয়েছে। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ১৬ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে:
- সেতু বিভাগ ১৪.৫৭ শতাংশ
- স্থানীয় সরকার বিভাগ ১৩.৮৫ শতাংশ
- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ১৩.৫৫ শতাংশ
- কৃষি মন্ত্রণালয় ১১.৪০ শতাংশ
সংশোধিত এডিপিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব:
এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনা কমিশন এবার এডিপি সংশোধনের কাজ এগিয়ে এনেছে। কর্মকর্তারা জানান, অর্থ বিভাগ ইতিমধ্যেই সংশোধিত এডিপির আকার নির্ধারণ করে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়েছে। প্রস্তাবে সরকারি তহবিল ও বিদেশি ঋণ মিলিয়ে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকারি তহবিলের বরাদ্দ ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে। বিদেশি ঋণ ও অনুদান অংশ ৮৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭২ হাজার কোটি টাকা করার কথাও বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি চূড়ান্ত হতে পারে।

