গত পাঁচ বছরে দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে তিন কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছেন। তবে ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণের হারও বেড়েছে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিবন্ধিত এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলো ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকায়। এর তুলনায় সরকারি সংস্থা ও ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম তেমন বেড়ে হয়নি।
এমআরএর তথ্যে দেখা যায়, মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ বিতরণ করছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এমএফআই প্রতিষ্ঠান। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক দিচ্ছে ২ শতাংশ, গ্রামীণ ব্যাংক ৮ শতাংশ, এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ৩ শতাংশ। বর্তমানে অনুমোদিত এমএফআই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৭০০। ঋণ পরিমাণ, বিতরণ ও গ্রাহকসংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠান হলো ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস ও সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস (এসএসএস)।
ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্র্যাকের কর্মকর্তা আসিফ সালেহ বলেন, “ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গত পাঁচ দশক ধরে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এটি চার কোটিরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যার ৯০ শতাংশ নারী। আমরা ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা মানুষকে সহায়তা করছি। বিশেষত দুর্গম এলাকায় এবং যারা স্বাভাবিকভাবে সেবা পান না, তাদেরকে সহায়তা করা আমাদের লক্ষ্য। আমরা সততা ও জবাবদিহির সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ব্র্যাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যুব দক্ষতা উন্নয়ন ও দারিদ্র্য কমানোর মতো সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও কাজ করছে। আমাদের লক্ষ্য মানুষকে শুধু অর্থে নয়, সামগ্রিকভাবে সক্ষম করে তোলা, যাতে তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।” এদিকে, এমআরএর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এমএফআই খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে এটি ছিল ৫.১৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা জানান, করোনাকালে এমএফআই ও ব্যাংকগুলো গ্রামে ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছিল। পরবর্তী সময়েও চাহিদা অব্যাহত থাকে। তবে গত অর্থবছরে অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নির্বাচনের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি কমেছে। অনেক ঋণগ্রহীতা সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, “ঋণ নিলে সবাই সফল হবেন, এমন নয়। উদ্যোক্তা মানেই ঝুঁকি নেওয়া। বিশ্বের যেকোনো দেশে ব্যাংক ঋণের ৩-৫ শতাংশ খেলাপি হওয়া স্বাভাবিক। এমএফআই-এর ৮৫ শতাংশ ঋণ আদায় হওয়া ইতিবাচক। ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া প্রান্তিক উদ্যোক্তার ব্যর্থতাও অর্থ দেশে থাকে, অন্য দেশে চলে যায় না। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সচেতন হতে হবে।” বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, এনজিও ও এমএফআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ক্ষুদ্রঋণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে এমএফআই প্রতিষ্ঠান বিতরণ করেছে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশে হাজারখানেক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এত প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজনীয় নয়। কিছু এমএফআই প্রতিষ্ঠান মুনাফার টাকা দিয়ে ঋণের আওতা না বাড়িয়ে জমি কিনছে। ফলে তহবিলের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি ২২টি সংস্থা ও বিভিন্ন সমবায় সমিতিও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্লেষকদের অভিযোগ, সমবায় সমিতিগুলো লোনশার্কের মতো আগ্রাসী ঋণ কার্যক্রম করছে।

