বিশ্বব্যাপী ক্যাশলেস ইকোনমি মডেলেও মোবাইল ব্যাংকিং ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের জন্য এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক নারীর কান্না দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছে। অল্প সময়ের মধ্যে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদে প্রকাশিত সেই নারীর কাঁদার দৃশ্য লাখ লাখ নেটিজেনের মধ্যে শেয়ার হয়। ভাইরাল হওয়া নারীর বাড়ি শেরপুরে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তিন বছর আগে তিনি গরু-ছাগল ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে ডাকঘরে একটি বিশেষ সঞ্চয় স্কিমে কষ্টার্জিত অর্থ জমা রাখেন। সম্প্রতি ওই সঞ্চয় স্কিম ভেঙে তিনি আড়াই লাখ টাকা পান।
তবে অভিযোগ, ওই আড়াই লাখ টাকার মধ্যে ৬৩ হাজার টাকা জাল। জাল নোটগুলো এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে সাধারণ চোখে তা ধরা পড়েনি। ব্যাংকে জমা দেয়ার সময় মেশিনে নোটগুলো ধরা পড়ে। সবশেষ খবর অনুযায়ী, বৃদ্ধাকে ওই জাল টাকাগুলো ফেরত দেয়নি ডাক বিভাগ।
রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ব্যাংক ব্যবস্থায় জাল টাকা ঢুকে যাওয়াটা অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, জাল টাকার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে আসল টাকার মূল্য হ্রাস, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি। যখন জাল নোট ব্যাংক বা অন্যান্য মাধ্যমে শনাক্ত হয়, তা বাজেয়াপ্ত হলে ব্যক্তি, শ্রেণী বা ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার সমমূল্য জাল নোট রয়েছে। এই নোট অর্থনীতিতে ক্যান্সারের মতো প্রভাব ফেলছে। গবেষণা বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটি কারণও জাল নোট।
এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ৮০ হাজার প্রকৃত নোটের বিপরীতে একটি করে জাল নোট বাজারে বিস্তার লাভ করেছে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ হিসাবের তুলনায় বাস্তবে অনেক বেশি জাল নোট রয়েছে। মার্কিন ডলারের ক্ষেত্রেও কমপক্ষে তিন কোটি জাল নোটের তথ্য উঠে এসেছে। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ও বাজারে প্রভাব কম নয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে জাল টাকার বিস্তার ব্যাপক। উন্নত বা অনুন্নত দেশ সবখানেই জাল নোট ছড়িয়ে আছে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি জাল নোট রয়েছে ব্রিটিশ পাউন্ডে, এরপর মার্কিন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে ইউরো, চতুর্থে মেক্সিকান পেসো এবং পঞ্চম অবস্থানে চীনা মুদ্রা। তবে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ জাল টাকার বিস্তার রোধে সফল হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া শীর্ষে, মালয়েশিয়া নব্বইয়ের দশকে ব্যাপকভাবে জাল নোটের সমস্যায় ভুগলেও ক্যাশলেস অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার তা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। একই পথ অনুসরণ করেছে সিঙ্গাপুর। এক কথায়, বিশ্ব এই “জাল টাকার রোগ” প্রতিরোধের যুদ্ধে নেমে পড়েছে।
ইতিহাসে নোট জালকরণ এত প্রচলিত ছিল যে বিভিন্ন পুস্তকে এটিকে “বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা” বলা হয়েছে। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে এশিয়া মাইনরে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। কাগজের মুদ্রা প্রবর্তনের আগে জালকরণের প্রধান পদ্ধতি ছিল খাঁটি সোনা বা রুপার সঙ্গে সস্তা ধাতু মিশিয়ে নকল তৈরি করা। চীনা সরকার একাদশ শতাব্দী থেকে কাগজের টাকা জারি করেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুঁতগাছের কাঠ ব্যবহার করে নোট তৈরি হতো। কাগজের অ্যাকসেস নিয়ন্ত্রণে তুঁত বনের চারপাশে রক্ষী মোতায়েন করা হতো, আর ধরা পড়া জালকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
ইংরেজ দম্পতি থমাস ও অ্যান রজার্সকে ১৫ অক্টোবর ১৬৯০ সালে ৪০টি রুপার টুকরো জাল করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। থমাসকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, আর অ্যানকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। একইভাবে, তথ্যদাতার প্রমাণের ভিত্তিতে ইংরেজ মুদ্রা নির্মাতা রাজা ডেভিড হার্টলিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭৭০ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সেই সময়ে জালকরণকে সাধারণ অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্র বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রে জালকরণ এত প্রচলিত হয় যে লেখক জন নিলের মতো সমসাময়িকরা দাবি করেছেন, তখনকার মুদ্রার অর্ধেকেরও বেশি জাল ছিল। ১৮৩০-এর দশকের মধ্যে আমেরিকান সংবাদপত্রগুলো জাল নোট শনাক্ত করার নির্দেশাবলি প্রকাশ করা শুরু করে। যেহেতু মুদ্রা পৃথক ব্যাংক দ্বারা জারি হতো, ১৮৬০-এর দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ ধরনের জাল নোট প্রচারিত হয়েছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের কৌশল হিসেবেও জাল মুদ্রা ব্যবহার করা হয়েছে। শত্রু দেশের অর্থনীতি দুর্বল করার লক্ষ্যেই এই পদ্ধতি নেয়া হতো। উদ্দেশ্য ছিল বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে আসল টাকার মূল্য কমিয়ে দেয়া।
১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সালের সাত বছরের যুদ্ধে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়ে পোলিশ অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে জাল মুদ্রা বাজারে ছাড়ে বিরোধী পক্ষ। ইতিহাসে আরও পাওয়া যায়, ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সালের আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রেট ব্রিটেন মহাদেশীয় ডলারের মূল্য কমাতে জাল নোট ব্যবহার করেছিল। তবে জাল নোটের মতো জটিল সমস্যাকে কয়েকটি দেশ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তারা ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই সংকট মোকাবিলা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর।
বিশ্ব অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি বা সাধারণ আর্থিক সাক্ষরতার ওপর ভরসা করে কোনো দেশই জাল নোট নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দীর্ঘ সীমান্ত এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সমস্যাটি আরও জটিল। সীমান্তপথে জাল নোটের প্রবেশ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। জাল নোট নিয়ন্ত্রণে সফল দেশগুলো কিছু কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিনামূল্যে বিশেষ কলম সরবরাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এসব কলম নাগরিকদের দিত। এই কলম দিয়ে নোটে দাগ দিলে জাল হলে দাগ কালো হয়ে যেত, আর আসল হলে রঙ সাদা বা কখনো সবুজ দেখা যেত। এতে বিশেষ আর্থিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন হতো না।
এ ছাড়া কিছু দেশ ছোট মেশিন ব্যবহার করে জাল নোট শনাক্তের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশেও ঈদুল আজহার সময় গরুর হাটে এ ধরনের মেশিন ব্যবহার হয়েছে। বর্তমান সময়ে জাল নোট এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি হয় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা চেনা প্রায় অসম্ভব। মেশিন ছাড়া শনাক্ত করা যায় না। আর এ সুযোগটাই নেয় জাল নোট কারবারিরা।
এক হাজার, ৫০০ বা অন্য মূল্যমানের নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য প্রচারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই প্রচার চালানো হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না। কারণ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জাল কারবারিরা আরও নিখুঁতভাবে নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য নকল করছে। ফলে খালি চোখে জাল নোট ধরা প্রায় অসম্ভব। বেশির ভাগ প্রচার বিজ্ঞাপনও আকর্ষণীয় নয়। ফলে মানুষের মনোযোগ পায় না। এ জায়গায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আকর্ষণীয় রিল বা ফুটেজ তৈরি করা যেতে পারে। কারণ ছাপা পত্রিকার চাহিদা এখন তলানিতে নেমে গেছে।
বর্তমানে একমাত্র মেশিনই জাল নোট শনাক্ত করতে সক্ষম। তাই এ মেশিন সহজে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মডেল অনুসরণযোগ্য। ২০১৮ সালের দিকে ভ্যাট প্রশাসন আড়ংসহ কয়েকটি সুপারশপে ইএফডি বা এসডিসি মেশিন চালু করতে পেরেছিল। এখন দেশে ৬০ হাজারের বেশি মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক মফস্বল উপজেলা সদরেও এসব মেশিন দেখা যায়। এনবিআর অল্প সময়ের মধ্যে তিন লাখ ইএফডি বা এসডিসি মেশিন স্থাপনের লক্ষ্যও ঘোষণা করেছে। এতে ভ্যাট ফাঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
একইভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা, তদারকি বা একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ধাপে ধাপে সারাদেশে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। যদি প্রতিটি ব্যাংক শাখা ও বুথে এই মেশিন বাধ্যতামূলক করা হয়, দুই বছরের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখা যাবে। বর্তমানে দেশে ১০ হাজারের বেশি ব্যাংক বুথ আছে। এর মধ্যে শুধু ডাচ্-বাংলা ব্যাংকেরই প্রায় পাঁচ হাজার বুথ। এসব বুথে একটি করে ছোট মেশিন বসানো হলে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে জাল নোট পরীক্ষা করতে পারবে।
এ ছাড়া বাজারভিত্তিক সমিতিগুলোতেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে দেশের প্রতিটি হাট-বাজারে আসা মানুষের আর্থিক সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। বিশ্বব্যাপী আরেকটি কার্যকর মডেল হলো ক্যাশলেস ইকোনমি। এই মডেলের আওতায় মোবাইল ব্যাংকিং ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার আরও বাড়ানো যায়। বিশেষ করে ছোট ছোট লেনদেনে মোবাইল ব্যাংকিংকে জনপ্রিয় করা জরুরি। সেবা আরও সহজ করতে হবে, যাতে প্রতিটি লেনদেনে ব্যবহার সম্ভব হয়। অ্যাপভিত্তিক লেনদেনও বাড়াতে হবে। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। অ্যাপে আরও সহজ ফিচার সংযোজনের মাধ্যমে এই পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।
ডেবিট কার্ডের ব্যবহারও বাড়ানো যেতে পারে। অনেকে ক্রেডিট কার্ডের সুদের যন্ত্রণা এড়াতে চায়। তাই ডেবিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটা উৎসাহিত করতে হবে। বর্তমানে গড়পড়তায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলারই ৭০০ কোটি টাকার বেশি। তাদের ৭০ লাখেরও বেশি গ্রাহক ডেবিট কার্ড ব্যবহার করছে। অন্যান্য ব্যাংককেও চেকের পরিবর্তে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করার নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া আন্তঃব্যাংক বুথ ব্যবহারে কোনো চার্জ রাখা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশে নগদ টাকা পরিবহনে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এই অর্থ অপচয় বন্ধ করার পাশাপাশি, অর্থনীতির ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত জাল টাকা রোধে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

