যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এ বছর বেশ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)–সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগে ব্যাপক উত্থান দেখা গেছে কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও অন্যান্য নীতির অনিশ্চয়তা বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এ বছর বেশ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)–সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগে ব্যাপক উত্থান দেখা গেছে কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও অন্যান্য নীতির অনিশ্চয়তা বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম শাটডাউন। এ কারণে কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতির সরকারি তথ্যপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটেছে, যা নীতিনির্ধারকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যাহত করেছে। বছর শেষে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
সম্ভাব্য তিনটি অবস্থার কথা বলা যায়। মূল বা সম্ভাব্যতামূলক দৃশ্যপট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র অল্প কিছু মাস স্বল্প প্রবৃদ্ধির মন্দায় (অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির নিচে নেমে যাওয়া) পড়বে, এরপর পুনরুদ্ধার হবে এবং মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের ২ শতাংশ লক্ষ্যের দিকে নামতে থাকবে। একে বলা যায় ‘গোল্ডিলক্স’ বা ভারসাম্যপূর্ণ দৃশ্যপট। দ্বিতীয় দৃশ্যপটে অর্থনীতি কয়েকটি প্রান্তিকে স্বল্প ও হালকা মন্দার মধ্য দিয়ে যাবে এবং প্রথম দৃশ্যপটটির তুলনায় ধীরগতিতে পুনরুদ্ধার হবে। আর তৃতীয় দৃশ্যপটে ‘নো-ল্যান্ডিং’ বা কোনো মন্দা না ঘটা পরিস্থিতি দেখা দেবে, যেখানে প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী থাকবে কিন্তু মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার দিকে নামবে না।
গোল্ডিলক্সই মূল দৃশ্যপট, কারণ বাজার শাসন ব্যবস্থা, দক্ষ উপদেষ্টাদের পরামর্শ এবং একটি স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ট্রাম্পের পর্যায়ক্রমিক হুমকির পরও) হোয়াইট হাউজকে ২ এপ্রিল ঘোষিত উচ্চ শুল্ক থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। এরপর থেকে প্রশাসন তুলনামূলকভাবে কম শুল্কবৃদ্ধি সংবলিত বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি ও কাঠামোতে পৌঁছেছে (যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে)। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে, তবে মূল্যস্ফীতি খুব বেশি বাড়েনি।
যদি আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে শক্তিশালী পুনরুদ্ধার দেখা দেয়, তা কয়েকটি কারণে সম্ভব হবে: ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) আরো মুদ্রানীতি শিথিলতা; যে আর্থিক প্রণোদনা এখনো কার্যকর হয়নি তার প্রভাব (সম্প্রতি প্রণীত অধিকাংশ ব্যয় সংকোচন নীতি ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর কার্যকর হবে); পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী আর্থিক অবস্থান; সহজ আর্থিক পরিবেশ (উচ্চ ইকুইটি মূল্য, নিচু বন্ড–ইল্ড ও ক্রেডিট স্প্রেড এবং দুর্বল ডলারের কারণে) এবং এআই-নির্ভর মূলধন ব্যয়ের (ক্যাপেক্স) শক্তিশালী অনুকূল প্রবাহ। তাছাড়া শুল্কের ভিত্তিগত প্রভাব কমতে শুরু করলে এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি খরচ কমাতে ও দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করলে মূল্যস্ফীতি শিগগিরই চূড়ায় পৌঁছে নামতে শুরু করতে পারে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় দৃশ্যপট—সংক্ষিপ্ত ও হালকা মন্দা এবং তুলনামূলক ধীর পুনরুদ্ধার। একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, যদিও এটি মূল দৃশ্যপটের চেয়ে কম সম্ভাব্য। শুল্কের প্রভাব সাধারণত কিছুটা সময় নিয়ে দৃশ্যমান হয়, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে, যা বাস্তব মজুরি কমিয়ে এবং ভোক্তা আস্থা আরো দুর্বল করে দিতে পারে। এরই মধ্যে ‘কে-আকৃতির অর্থনীতি’ নিয়ে আলোচনা চলছে—যেখানে উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো ভালো করছে, কিন্তু নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো চাপে আছে। এআই–বুদ্বুদ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে এবং শেয়ারবাজারে বড় সংশোধন ও দুর্বল পুঁজি ব্যয়ের পরিবেশ তৈরি হলে ব্যবসায়িক আস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ অবস্থাতেও মন্দা হবে স্বল্প ও হালকা। কারণ ফেড আরো আগ্রাসীভাবে সুদের হার কমাবে এবং আর্থিক কর্তৃপক্ষ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অতিরিক্ত প্রণোদনা দিতে পারে।
শেষত, তৃতীয় বা ‘নো-ল্যান্ডিং’ দৃশ্যপটকেও একেবারে বাদ দেয়া যায় না। কারণ সাম্প্রতিক কিছু সূচক দেখাচ্ছে যে অর্থনীতি অনেকের ধারণার চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। উদাহরণস্বরূপ, কর্মসংস্থান তৈরির ধীরগতি হয়তো শ্রম–সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন দমননীতির ফল হিসেবে এবং নতুন বা সদ্য গ্রহণকৃত প্রযুক্তি থেকে প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে। সীমিত পণ্য ও শ্রমবাজার মজুরি বাড়াবে এবং সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে; আর খাদ্য ও জ্বালানি বাদে মূল মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। এ পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারক ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটির যারা অর্থনীতির ‘ওভারহিটিং’ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের মতই প্রাধান্য পাবে এবং ফেড যতদিন প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার ওপরে ও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যের ওপরে থাকবে, ততদিন সুদের হার কমানো থেকে বিরত থাকবে।
তবু শেষ দৃশ্যপটটি মূল দৃশ্যপট নয়, কারণ সাম্প্রতিক আরো কিছু সূচক অর্থনৈতিক দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করছে। তাছাড়া নানা ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। যেমন মার্কিন-চীন বাণিজ্য উত্তেজনার আরো অবনতি বা নতুন কোনো সংঘাতে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকছে। এমনটা হলে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশটি মন্দার দিকে যেতে পারে। সৌভাগ্যবশত এ ধরনের ধাক্কা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত আছে এবং আশা করা যায় যে তা নিয়ন্ত্রিতই থাকবে।
যদি ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে এবং চীনের অর্থনীতি দৃঢ় থাকে ও ৫ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখে, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চিত্র উন্নত হবে। উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলো ২০২৫ সালের তুলনায় বেশি প্রবৃদ্ধির পথে অগ্রসর হবে। যদিও উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি রয়ে গেছে, নতুন বছরে প্রবেশের সময় সতর্ক আশাবাদী হওয়া যেতে পারে।
নুরিয়েল রুবিনি: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক।

