স্বাস্থ্যসচেতন জীবনধারার দিকে ঝুঁকে পড়ায় দেশে দেশে বাইসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে। সেই চাহিদার ওপর ভর করে বৈশ্বিক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করছিল বাংলাদেশের বাইসাইকেল। তবে করোনার প্রভাব ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে সেই বাজারে ধাক্কা লাগে। ফলস্বরূপ দুই বছর ধরে পরিবেশবান্ধব এই বাহনের রপ্তানি কমে যায়। পরবর্তীতে আবার বাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেল রপ্তানির নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ। মোট রপ্তানির ৬৭ শতাংশই এই শিল্পগোষ্ঠীর দখলে। শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারকের মধ্যে শীর্ষ দুইটি প্রতিষ্ঠানও মেঘনা গ্রুপের, যথা এমঅ্যান্ডইউ সাইকেল ও হানা সিস্টেম। নতুন বিনিয়োগও আসছে, যদিও কম। দুই দশকের বেশি সময় তৈরি পোশাক রপ্তানির পর বাইসাইকেল উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে পানাম গ্রুপ। এক বছরের ব্যবধানে তারা শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারকের মধ্যে স্থান পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তারা রপ্তানিতে তৃতীয় শীর্ষে। চতুর্থ শীর্ষ রপ্তানিকারক হলো আরএফএল গ্রুপের রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। পঞ্চম স্থানে রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগে স্থাপিত আলিটা (বিডি) লিমিটেড, যা দেশের প্রথম বাইসাইকেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বাইসাইকেলের বড় গন্তব্য ইউরোপ। একক শীর্ষ বাজার জার্মানি। তবে দেশের থেকে সরাসরি রপ্তানি করছে মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান। শীর্ষ পাঁচের বাইরে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেঘনা গ্রুপের ইউনিগ্লোরি সাইকেল কম্পোনেন্টস, মেঘনা বাংলাদেশ লিমিটেড, করভো সাইকেল ও জিন চ্যাং সুজ। মাহিন সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ডলারের রপ্তানি করলেও গত বছর তাদের রপ্তানি নেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, করোনার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ১৭ কোটি ডলার। পরের বছর রপ্তানি কমে ২৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১৪ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে ৪৫ শতাংশ, মাত্র সোয়া ৮ কোটি ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈশ্বিক বাজারে বাইসাইকেলের মন্দা দেখা দিয়েছিল। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। রপ্তানি হয় ১১ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের বাইসাইকেল, যা ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের বাইসাইকেল, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪১ শতাংশ বেশি। মো. লুৎফুল বারী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, টায়ার ডিভিশন, মেঘনা গ্রুপ, জানান, “বাজারে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় রপ্তানি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে।”
শীর্ষ পাঁচের মেঘনার দুই:
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেল রপ্তানির নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ। গ্রুপের মোট সাতটি কারখানার মধ্যে চারটি যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মেঘনা গ্রুপ ৭ কোটি ৮১ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করেছে। এ হিসেবে মোট রপ্তানির ৬৭ শতাংশই মেঘনার দখলে। গ্রুপ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, তারা মোট ৮ কোটি ১২ লাখ ডলারের রপ্তানি করেছে।
শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারকের মধ্যে মেঘনার দুটি প্রতিষ্ঠান—এমঅ্যান্ডইউ সাইকেল ও হানা সিস্টেম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এমঅ্যান্ডইউ সাইকেল ৪ কোটি ডলার এবং হানা সিস্টেম ২ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করেছে। হানা সিস্টেম জার্মানির একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় এমঅ্যান্ডইউ সাইকেলের রপ্তানি বেড়েছে ৪২.৪৫ শতাংশ, আর হানা সিস্টেমের রপ্তানি বেড়েছে ৭.২৭ শতাংশ।
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার বাবা আবদুল খালেক ১৯৭৬ সালে তেজগাঁওয়ের সাইকেলের একটি কারখানা কিনেছিলেন। পরে নাম বদলে হয় মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ। ১৯৮৬ সালে বাবা মারা গেলে ব্যবসার দায়িত্ব নেন মিজানুর রহমান। তার হাত ধরেই মেঘনার সাইকেল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে তিনি তেজগাঁওয়ের সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ কিনে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৯৮ সালে দেশের বাজারের জন্য সাইকেল উৎপাদন শুরু হয়। পরের বছর প্রথম রপ্তানি ক্রয়াদেশ আসে ইংল্যান্ড থেকে। প্রথম চালানের কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় মিজানুর রহমান সেগুলো পাঠানোর পরিবর্তে ফেরৎ নেন। পরে আবারও ক্রয়াদেশ আসে এবং তখন থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
মেঘনা গ্রুপের টায়ার ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লুৎফুল বারী বলেন, “২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈশ্বিক বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু গত অর্থবছরে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রবৃদ্ধি বেশি দেখা যাচ্ছে।” ইউরোপের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। যুদ্ধের কারণে অনেকেই কেনাকাটা কমিয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হচ্ছে। অন্যদিকে পাল্টা শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন রপ্তানি বাজার হিসেবে সামনে এসেছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানিয়েছেন, “আমরা নতুন বাজারে দৃষ্টি দিয়ে রপ্তানি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছি।”
ইলেকট্রিক বাইকও রপ্তানি হচ্ছে:
নতুন বিনিয়োগ হিসেবে পানাম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পানাম সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে রপ্তানি শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ কারখানায় ৪০০ কর্মী কাজ করছেন। বর্তমানে ইউরোপের বাজারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের জন্যও উৎপাদন চলছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পানাম গ্রুপ ১ কোটি ২২ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করেছে। এর আগের বছর রপ্তানি ছিল ৪৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৭১ শতাংশ। পানাম সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ গত বছর থেকে ইলেকট্রিক বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করেছে। চলতি বছরে ডেনমার্কের একটি ক্রেতার জন্য প্রথম চালান রপ্তানি করেছে এবং এরপর ইইউর অন্যান্য ক্রেতাদের জন্যও ইলেকট্রিক বাইসাইকেল প্রস্তুত করছে।
মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ইফতেখার আহমেদ জানান, “ইলেকট্রিক বাইসাইকেলের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে বিক্রি হওয়া মোট বাইসাইকেলের ৩০ শতাংশই ইলেকট্রিক। ক্রেতাদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পাচ্ছি। নীতিসহায়তা পেলে রপ্তানি আরও বাড়বে।”
মেঘনার সঙ্গে অন্যরাও এগোচ্ছে:
আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের চতুর্থ শীর্ষ বাইসাইকেল রপ্তানিকারক। হবিগঞ্জ ও রংপুরে তাদের দুটি কারখানা রয়েছে। রংপুরে নতুন আরও একটি কারখানা নির্মাণাধীন, যা আগামী বছর উৎপাদন শুরু করবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রংপুর মেটাল ১ কোটি ১৮ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করেছে। তাদের সাইকেলের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ ডলার।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “ইউরোপের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। যুদ্ধের কারণে অনেক ক্রেতা কেনাকাটা কমিয়েছিল, এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। পাল্টা শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন রপ্তানি বাজার হিসেবে সামনে এসেছে। গত অর্থবছরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছি। চলতি অর্থবছরও এই ধারা চলছে।” তিনি আরও বলেন, “সাইকেল রপ্তানি বাড়াতে হলে পরীক্ষাগার স্থাপনের পাশাপাশি সরঞ্জাম উৎপাদনের সংযোগ শিল্প গড়ে তুলতে হবে।”
দেশের প্রথম বাইসাইকেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো আলিটা (বিডি) লিমিটেড। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানা নির্মাণ শুরু করেন তাইওয়ানের নাগরিক ইয়ে চেং মিন। ১৯৯৫ সালে প্রথম রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে আলিটা কারখানায় ৪০০ শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটি মূলত ৮০ থেকে ২০০ ডলারের মাউন্টেন বাইসাইকেল রপ্তানি করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলিটা ৮৭ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি। আলিটা (বিডি) লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস জানান, “ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় বেড়েছে। আশা করছি, আগামী দিনগুলোতে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়বে।”
বাংলাদেশের বাইসাইকেল শিল্পে নতুন বিনিয়োগ ও বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে। শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অন্যান্য রপ্তানিকারকরাও বাজারে তাদের অবস্থান শক্ত করছে। এটি দেশীয় বাইসাইকেল শিল্পের জন্য আশাব্যঞ্জক সংযোজন।

