চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার দুই হাজার কোটি টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাত লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাজেট-সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
বৈঠকে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপন করেন অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। তিনি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপরও একটি পৃথক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শুরুতে বাজেট কাটছাঁট করে সাত লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায় নামানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সুদ পরিশোধ ও ভর্তুকি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংক একীভূতকরণে মূলধন সহায়তা, সরকারি চাকরিজীবীদের ভাতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য খাতে পরিচালন ব্যয়ের বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের কাটছাঁট সম্ভব হয়নি। সংশোধিত বাজেট আগামী জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ছিল পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে প্রায় পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। এদিকে এডিপি বরাদ্দ দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় থেকে কমিয়ে দুই লাখ কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায় করা হচ্ছে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ৫.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। মূল কারণ হলো কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়া।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর বাজেট বাস্তবায়ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যয় মন্থর থাকে। ব্যয় বৃদ্ধি শুরু হয় মূলত তৃতীয় প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) থেকে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় জুনে। তবে চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকেই পরিচালন ব্যয়ের ওপর ভর করে ব্যয়ের প্রবণতা বেড়েছে।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকার এক লাখ চার হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৯৯ কোটি এবং উন্নয়ন খাতে ১০ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৯৫ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। তখন পরিচালন খাতে ব্যয় ছিল ৮৪ হাজার ৫৮৬ কোটি এবং উন্নয়ন খাতে ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দেশের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালের জুনের পর গত নভেম্বরে প্রথমবারের মতো ৯ শতাংশের নিচে নেমেছে। আশা করা যায়, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে জুন শেষে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধির মধ্যে ফারাক অনেক বেশি ছিল। এতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমছিল। চলতি অর্থবছরের সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফারাক কমেছে। নভেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশ এবং মজুরি প্রবৃদ্ধি ৮.০৪ শতাংশ হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই হার যথাক্রমে ৯.০২ ও ৭.০৪ শতাংশ ছিল।
কৃষি খাতেও পরিস্থিতি ইতিবাচক। গত অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে আমন ধানেও ভালো ফলন হবে। সরকারের আশা, চলতি অর্থবছরে খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ইতোমধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে এসেছে। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২.৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের আগস্টে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ছিল। রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পাঁচ লাখ কর্মীর বৈদেশিক নিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৯৭ হাজার। একই সময়ে প্রবাসী আয় দেশে এসেছে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যা গত বছরের তুলনায় ১৭.১৪ শতাংশ বেশি। আমদানিতে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল।

