১৯৭৫ সালে দীর্ঘ মার্কিন যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম একত্রিত হয়। তখন কমিউনিস্ট সরকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে দেশটির বড় শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য জাতীয়করণ করে। তবে ফল উল্টো হয়। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৪৫৪ শতাংশে পৌঁছে। অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ভিয়েতনামের সরকার ১৯৮৬ সালে অর্থনৈতিক সংস্কার আনে। স্থানীয় ভাষায় এটি ‘দইমই’ নামে পরিচিত। দেশটি বাজার উন্মুক্ত করে। বিদেশি কোম্পানির জন্য কর অবকাশ ও নানা সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহিত হতে শুরু করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ায়।
একসময়ের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশটি গত চার দশকে বিদেশি বিনিয়োগের বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিদেশি বিনিয়োগ ও পণ্য রপ্তিই এখন ভিয়েতনামের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। গত ১৫ বছরে দেশটির অর্থনীতি গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের জিডিপি ছিল ৪৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৯৩ শতাংশই রপ্তানি খাত থেকে এসেছে।
ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে ভিয়েতনামের দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানি ছিল ৫.৪৫ বিলিয়ন ডলার। প্রতি পাঁচ বছরে রপ্তানি দ্বিগুণ বা তার বেশি বেড়েছে। বিদায়ী বছরে রপ্তানি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। অর্থাৎ ৩০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৭৩ গুণ।
ভিয়েতনামের বিদেশি বিনিয়োগের সূচনা হয় তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। তুলনামূলক কম বেতনের শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে নাইকি, অ্যাডিডাসের মতো প্রতিষ্ঠান দেশটিতে কারখানা স্থাপন করে। পরে দেশটি ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ে। দেশি-বিদেশি তরুণ প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলীরা বড় শহরগুলোতে কাজ করতে আসে। বর্তমানে শীর্ষ রপ্তানি পণ্য ইলেকট্রনিকস।
রপ্তানি খাত এক বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে রপ্তানি হয়েছে:
- ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা: ১৩৪ বিলিয়ন ডলার
- যন্ত্রপাতি: ৫২ বিলিয়ন ডলার
- তৈরি পোশাক: ৩৭ বিলিয়ন ডলার
- জুতা: ২৩ বিলিয়ন ডলার
- মাছ: ১০ বিলিয়ন ডলার
- কাঠ ও কাঠ পণ্য: ১৬ বিলিয়ন ডলার
- ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্য: ১৩ বিলিয়ন ডলার
- প্লাস্টিক পণ্য: ৬ বিলিয়ন ডলার
- চাল: ৫.৬৬ বিলিয়ন ডলার
- কফি: ৫.৬২ বিলিয়ন ডলার
ভিয়েতনামের অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে শক্ত অবস্থানে এসেছে।
ভিয়েতনাম মডেল’ কী:
ভিয়েতনামের বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং পণ্য রপ্তানিতে সাফল্যের পেছনে রয়েছে ‘ভিয়েতনাম মডেল’। এর কেন্দ্রবিন্দু হলো ১৯৮৬ সালে চালু হওয়া দইমই কর্মসূচি। এর মাধ্যমে জনগণের জমির ওপর অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া হয়।
দইমই কর্মসূচির তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
১. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে শক্ত হাতে উদারীকরণ।
২. অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ ও সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে ব্যবসা করার খরচ ও বাধা কমানো।
৩. রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানব উন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া।
ভিয়েতনাম একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতেও মনোযোগী হয়। ১৯৯৫ সালে দেশটি আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে যোগ দেয়। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে। পরে ২০০৭ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) তে যোগ দেয়। এরপর জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একাধিক বাণিজ্য চুক্তি করে। এই সব উদ্যোগ বিদেশি বিনিয়োগের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হলো জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, এরপর চীন, তাইওয়ানসহ অন্যান্য দেশ।
ভিয়েতনামের বিনিয়োগ পরিবেশ, দীর্ঘমেয়াদি নীতিসহায়তা, দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ এবং চীনের তুলনায় কম খরচের সুবিধা ২০০৮ সালে স্যামসাংকে দেশটিতে স্মার্টফোন কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করে। স্যামসাং বিনিয়োগ ভিয়েতনামের জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করে। এর পথ অনুসরণ করে এলজি, ইন্টেল ও ফক্সকনও দেশটিতে বিনিয়োগ করে।
স্যামসাং এখন পর্যন্ত ছয়টি উৎপাদন কারখানা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে ২২.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। গত বছর দেশ থেকে স্যামসাং পণ্য রপ্তানি করেছে ৫৪ কোটি ডলার মূল্যে।
বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগ ভিয়েতনামের রপ্তানি শক্তির মূল:
ভিয়েতনামের পণ্য রপ্তানিতে সাফল্যের পেছনে বৈচিত্র্যময় বিদেশি বিনিয়োগের বড় অবদান রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটি ৫০২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। এসব বিনিয়োগ এসেছে ৬৩টি দেশ থেকে, যার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান, হংকং, চীন, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া উল্লেখযোগ্য।
ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস অফিসের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া ৮৩ বিলিয়ন, সিঙ্গাপুর ৭৮ বিলিয়ন, তাইওয়ান ৪১ বিলিয়ন, হংকং (চীন) ৩৮ বিলিয়ন এবং চীনের কোম্পানি ৩১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ৩৮ হাজার বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্প দেশটিতে নিবন্ধিত হয়েছে।
ভিয়েতনাম এখনও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশটি পেয়েছে ৩১.৫২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা ১ হাজার ২০৬ প্রকল্পে ১২ বিলিয়ন ডলার, নতুন বিনিয়োগকারীরা ১৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাকি ৫.৫ বিলিয়ন ডলার এসেছে দেশটির আবাসন খাত থেকে।
বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগের প্রভাব রপ্তানি খাতে স্পষ্ট। ২০০৫ সালে ভিয়েতনামের স্মার্টফোন রপ্তানি ছিল প্রায় শূন্য। স্যামসাংয়ের বিনিয়োগে ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে রপ্তানি দাঁড়ায় ৩০ বিলিয়ন ডলার, এবং গত বছর ৫৪ বিলিয়ন ডলার। জুতা রপ্তানিও একইভাবে বেড়েছে। ২০০৫ সালে ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৫ সালে বেড়ে ১২ বিলিয়ন এবং গত বছর ২২ বিলিয়ন ডলার।
অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও রপ্তানি বিস্তৃত। ১৫ বছর আগে যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, প্লাস্টিক উপকরণ, কফি, আসবাব, খেলনা প্রায় শূন্য রপ্তানি করত দেশটি। এখন এগুলোর রপ্তানি বিপুল:
- যন্ত্রপাতি: ৫২ বিলিয়ন ডলার
- ক্যামেরা: ৮ বিলিয়ন ডলার
- অন্যান্য পণ্য (প্লাস্টিক উপকরণ, কফি, আসবাব, খেলনা) কয়েক বিলিয়ন ডলার
এই বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগ ভিয়েতনামের রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে।
প্রসঙ্গ এবার বাংলাদেশ:
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের অনেক মিল রয়েছে। দুই দেশই এক সময় কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল। ভিয়েতনাম দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালে একত্রিত হয়। তার চার বছর আগে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
নব্বইয়ের দশকে উভয় দেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভর করে এগোতে শুরু করে। তবে পরে ভিয়েতনাম বৈচিত্র্যময় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে দ্রুত এগিয়ে যায়। বাংলাদেশ সেই তুলনায় চার দশক ধরে এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে।
তৈরি পোশাকেও বাংলাদেশ ভিয়েতনামের খুব বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার, আর ভিয়েতনামের ছিল ৪.৭ বিলিয়ন ডলার। তবে গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ৩৯ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
ভিয়েতনামের এগিয়ে থাকার একটি উদাহরণ আসবাব রপ্তানি। ২০০৫ বা ২০১০ সালে ভিয়েতনাম থেকে কোনো আসবাব রপ্তানি হতো না। ২০১৫ সালে রপ্তানি হয় ৭৬ কোটি ডলার, আর গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪১ কোটি ডলার। বাংলাদেশে একই সময়ে রপ্তানি খুবই সীমিত। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আসবাব রপ্তানি ছিল ৪ কোটি ডলার, গত বছর মাত্র ৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এ থেকে স্পষ্ট, ভিয়েতনামের বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগ ও রপ্তানি খাত বাংলাদেশকে পেছনে রেখেছে।

