দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ভারসাম্যহীনতা এখন একটি স্থিতিশীল অবস্থানে এসেছে। এই তথ্য উঠে আসে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও বাজেট ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
বৈঠকে জানানো হয়, অতীতের আর্থিক অব্যবস্থাপনার ফলে দেশের ইমেজে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কমানো সম্ভব হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ঋণপত্র খোলার হার বৃদ্ধি এবং ট্রেড ফিন্যান্সিং সহজ হওয়াকে তুলে ধরা হয়। আলোচনা হয়েছে মূল্যস্ফীতি, মজুরি প্রবৃদ্ধি, আর্থিক ও বৈদেশিক খাত, চলতি হিসাব, প্রবাস আয়, আমদানি ও ঋণপত্র-সংক্রান্ত অগ্রগতির ওপর।
গত ১২ মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালের জুনের পর নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো ৯ শতাংশের নিচে নেমেছে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট হিসেবে ২০২৩ সালের মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩৩ শতাংশ। এরপর জুনে এটি ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে এবং নভেম্বর মাসে আরও কমে ৮.২৯ শতাংশে দাঁড়ায়। আশা করা হচ্ছে, সরকারের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে আগামী জুনে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামবে।
বিগত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধির মধ্যে ফারাক ছিল অনেক। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে আসছিল। তবে চলতি অর্থবছরের সাম্প্রতিক সময়ে এ ফারাক অনেক কমে এসেছে। নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৮.২৯ ও ৮.০৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড়ে ৯.০২ ও ৭.০৪ শতাংশের তুলনায় ভালো অবস্থা। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কমে যাওয়া প্রকৃত আয় ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হবে।
কৃষি খাতে যথাযথ প্রণোদনা ও ব্যবস্থাপনার ফলে বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটায় আমন ধানেরও ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমন ধানের উৎপাদন ১৬০.৯৫ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। অবশিষ্ট ফসল কেটে নেওয়ার পর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আউশ ধানের উৎপাদন সামান্য কমলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭.২০ শতাংশ বেড়েছে।
আর্থিক ও বৈদেশিক খাতের অগ্রগতি সম্পর্কেও সভায় তথ্য দেওয়া হয়। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২.৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের আগস্টে ছিল প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হওয়া, প্রবাস আয়ের বৃদ্ধি এবং সুদের হারের উত্থানের কারণে রিজার্ভ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০১৬-১৭ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত চলতি হিসাব ধারাবাহিকভাবে ঋণাত্মক ছিল। ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ সালে এ পরিমাণ যথাক্রমে মাইনাস ১৮.৭, ১১.৬ ও ৬.৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুব্যবস্থাপনা ও অর্থ পাচার রোধের ফলে এটি কমে মাইনাস ১৩৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে চলতি হিসাব ঘাটতি ছিল মাইনাস ৭৪৯ মিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পাঁচ লাখ কর্মীর বৈদেশিক নিয়োগ হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ে তিন লাখ ৯৭ হাজারের তুলনায় অনেক বেশি। একই সময়ে প্রবাস আয় ১৩.০৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৭.১৪ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও উৎপাদনশীল করতে আমদানিতে বিধিনিষেধ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১.২ শতাংশ ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ৬.১ শতাংশে পৌঁছেছে।
মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল মাইনাস ৩২.৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে এটি বেড়ে ২৭.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিল্পজাত কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে প্রবৃদ্ধি ১০.১ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৪০.৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

