অন্নপূর্ণা দেবী, ভারতীয় সঙ্গীতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর সঙ্গীত জীবন ও কর্মের প্রভাব সঙ্গীত জগতের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। তাঁর সঙ্গীতের প্রতি গভীর প্রেম ও নিবেদন তাঁকে বিশ্বসঙ্গীতের এক বিশিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ প্রতিবেদনে অন্নপূর্ণা
অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি ১৯২৭ সালে ভারতের বর্তমান মধ্যপ্রদেশে মাইহার রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম রোশনারা আলী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তখন মহারাজা ব্রিজনাথ সিংয়ের রাজসভার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। মহারাজ তাঁর নাম রাখেন অন্নপূর্ণা। তাঁর চাচা ফকির আফতাবউদ্দিন খান এবং আয়েত আলী খান। দুজনেই ছিলেন তাদের নিজেদের এলাকা শিবপুরের (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) বিখ্যাত সঙ্গীতসাধক। তাঁর ভাই আলী আকবর খানও ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়েছিল পিতার কাছেই। তাঁর পিতার সঙ্গীতের মৌলিক শিক্ষা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ তাঁকে সঙ্গীতের জগতে প্রবেশের প্রেরণা দেয়। পিতা-মাতার সঙ্গীতের প্রতি নিবেদন তাঁকে সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। কলকাতায় আসার পর, তিনি বিভিন্ন প্রখ্যাত গায়কদের কাছ থেকে সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখা ও ধারা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে শুরু করেন।
১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে কলকাতায় এসে, অন্নপূর্ণা দেবী আধুনিক ভারতীয় সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন। কলকাতার সঙ্গীত জগতে প্রবেশ তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। এখানকার সঙ্গীত পরিবেশ তাঁর সঙ্গীতের দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনল। তিনি দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন এবং সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা ও শাখায় তাঁর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত জীবনের অগ্রযাত্রা মূলত রাগ মিউজিক এবং তালের উপর তাঁর বিশেষ মনোযোগের মাধ্যমে পরিণত হয়। তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে একটি গভীর গাম্ভীর্য এবং সংবেদনশীলতা ছিল যা শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর পরিবেশনায় বিশেষ করে বিভিন্ন রাগের সাবলীল উপস্থাপনা ও তালের সূক্ষ্মতা শ্রোতাদের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনে বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার তাঁর সঙ্গীতের প্রতি নিবেদন ও সাফল্যের প্রমাণ:
পদ্মভূষণ (১৯৭৭): ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এই সম্মাননা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য প্রদান করা হয়। এটি ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সিভিল সম্মান।
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (১৯৭০): ভারতের সঙ্গীত ও নাটক শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।
জওহরলাল নেহেরু পুরস্কার (১৯৭৫): এই পুরস্কার সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দেওয়া হয়।
ইন্দিরা গান্ধী পিইএস পুরস্কার (১৯৮৯): সঙ্গীতের উৎকর্ষতার জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এছাড়াও ১৯৯১ সালে নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং বিশ্বভারতী থেকে ১৯৯৯ সালে সম্মানজনক দেশিকোত্তম উপাধি দেওয়া হয়।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য গান তাঁর সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য ও শক্তি প্রদর্শন করে:
“ভাস্করের প্রেমে”: এই গানে তাঁর সুরের গভীরতা ও গাম্ভীর্য স্পষ্ট। গানটি প্রথাগত রাগের মধ্যে একটি নতুন সুরের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, যা শ্রোতাদের একটি গভীর অনুভূতি প্রদান করে।
“রূপবতী”: এই গানে অন্নপূর্ণা দেবী তাঁর সঙ্গীতের বিশিষ্টতা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দেন। গানটির তালের সূক্ষ্মতা ও সুরের গভীরতা তাঁর সঙ্গীতের শক্তি ও প্রতিভাকে প্রকাশ করে।
“মোহিনী”: সঙ্গীতের একটি ক্লাসিকাল রূপ, যা সুরের সৌন্দর্য ও ধীরগতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। গানটির পরিবেশনা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের বিশেষত্ব এবং শিল্পের প্রতি নিবেদন প্রকাশ করে।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর নিভৃতচারিতা। তিনি কোনও বাণিজ্যিক প্রচারণায় অংশগ্রহণ না করে, বরং এক নির্জন জীবনে সঙ্গীতের সাধনা করেছেন। তাঁর নিভৃতচারী জীবন সঙ্গীতের প্রতি তাঁর গভীর নিবেদন ও একাগ্রতা প্রদর্শন করে। জনসাধারণের সামনে আসার চেয়ে, সঙ্গীতের প্রকৃত উৎকর্ষতার প্রতি তিনি অধিক মনোযোগী ছিলেন।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের প্রভাব শুধু ভারতীয় সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক সঙ্গীত সমাজেও একটি বিশেষ স্থান অর্জন করেন। তাঁর সঙ্গীতের বিভিন্ন প্রকার, যেমন হিন্দুস্তানি সঙ্গীত ও খেয়াল, নতুন রূপে তুলে ধরে তিনি সঙ্গীতের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছেন। তাঁর সঙ্গীতের কাজগুলি সঙ্গীতের ধরণ এবং রীতির প্রসারে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্নপূর্ণা দেবীর জীবন ও কর্মের বিশ্লেষণ আমাদেরকে সঙ্গীতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শেখায়। তাঁর নিভৃতচারী জীবন ও সঙ্গীতের প্রতি অটুট অঙ্গীকার আমাদেরকে সঙ্গীতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সহায়তা করে। অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের যাত্রা এবং তাঁর কর্মজীবনের সফলতা সঙ্গীতের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে স্থান পাবে। তাঁর সঙ্গীতের শিল্প ও জীবন সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য একটি চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত জীবনের মূল্যায়ন করলে বোঝা যায় যে, তিনি সঙ্গীতের প্রতি একটি অটুট প্রেম ও নিবেদন নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর সঙ্গীতের গভীরতা, শুদ্ধতা, এবং মৌলিকতা তাঁকে সঙ্গীতের অমরত্ব প্রদান করেছে। তাঁর সঙ্গীতের প্রকৃতি এবং জীবন আমাদের প্রমাণ করে যে, প্রকৃত সঙ্গীত শুধুমাত্র একটি শিল্প নয়, বরং একটি সাধনা যা আমাদের আত্মাকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীত জীবনের বিশ্লেষণ আমাদের প্রমাণ করে যে, একজন সঙ্গীতজ্ঞের জীবনের সার্থকতা তাঁর কাজের গভীরতা ও প্রতিভায় নিহিত। তাঁর সঙ্গীতের শিল্প ও সৃষ্টিশীলতা সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, এবং তাঁর জীবন ও কাজের অধ্যায় সঙ্গীত ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।