বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতে এক অমূল্য নাম অমলেন্দু বিশ্বাস, যিনি অমল বোস নামেই পরিচিত। টেলিভিশন নাটক থেকে শুরু করে ঢালিউডের রূপালি পর্দা, মঞ্চ এবং ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান—সবখানেই তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি-তে “নানা-নাতি” কৌতুক নাটিকায় নানার চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় বাংলাদেশের দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে দেয়। তবে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি এই গুণী অভিনেতার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বন্ধ হয় এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
“নানা-নাতি” নাটিকায় নাতির চরিত্রে অভিনয় করা শওকত আলী তালুকদার নিপুর সঙ্গে অমল বোসের সম্পর্ক ছিল মঞ্চের বাইরেও পারিবারিক। অমল বোসকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিপু বলেন, “আমি আর দাদা ছিলাম মানিকজোড়। দর্শকরা আমাদের নানা-নাতি মনে করলেও আমি তাকে সবসময় দাদা বলে ডাকতাম। সেই সম্পর্ক আজও আমার হৃদয়ে অমলিন।”
নানা-নাতি চরিত্রে একসঙ্গে কাজ করার সময় তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। নিপু জানান, “দাদা আমাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছেন—কীভাবে অভিনয় করতে হয়, কীভাবে দর্শকের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। তিনি আমাকে বলতেন, ‘দর্শকরাই শিল্পীর প্রাণ।’”
নিপুর কণ্ঠে উঠে আসে জীবনের শেষ দিনগুলোতে অমল বোসের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও আক্ষেপের কথা। মৃত্যুর আগে অমল বোস মাছ খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার চলে যাওয়ার কারণে নাতি তাকে সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি। “এই আক্ষেপ আমার সারাজীবন মনে থাকবে,” বলেন নিপু। “যখন নানার জন্য কিছু নিয়ে যেতাম, তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু মাছ খাওয়ানোর সুযোগ আর পেলাম না। তার মৃত্যুতে আমি বিদেশে থাকায় শেষ দেখা দেখতেও পারিনি। এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি প্রতিদিন।”
১৯৪৩ সালে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন অমল বোস। অভিনয়ের প্রতি তার ভালোবাসা শুরু হয় যাত্রাপালায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালে রাজা সন্ন্যাসী সিনেমার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর একে একে উপহার দিয়েছেন নীল আকাশের নিচে, মহুয়া, সোনালি আকাশ, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, আমি সেই মেয়ে, তোমাকে চাই, মন, হঠাৎ বৃষ্টি, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-এর মতো জনপ্রিয় সিনেমা।
অমল বোস শুধু অভিনেতা ছিলেন না; তিনি পরিচালনার জগতেও নাম লিখিয়েছিলেন। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা কেন এমন হয় সত্তরের দশকে তাকে আরও পরিচিতি এনে দেয়।
২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অমল বোস। তার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভিনয় জগৎ হারিয়েছে এক গুণী শিল্পীকে। তবে তার কাজ এবং দর্শকদের প্রতি ভালোবাসা আজও তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
অমল বোসের জীবন শুধু একজন শিল্পীর নয় বরং একজন মানবিক, বন্ধুবৎসল ও শিক্ষকের জীবন। তার স্মৃতি, তার শিক্ষা এবং তার অভিনয়শৈলী থেকে প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক কিছু শিখতে পারবেন। নিপুর মতো যারা তাকে কাছ থেকে পেয়েছেন। তাদের জন্য তিনি একজন শিক্ষক, বন্ধু এবং পরিবারের অংশ হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।