গত ১৫ ও ১৬ অক্টোবরের তারিখ সম্বলিত কয়েকটি মার্কিন গোপন গোয়েন্দা নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনায় নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক। এই নথিগুলোতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশল বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। ফাঁস হওয়া নথিগুলো প্রথমবারের মতো ১৩ অক্টোবর টেলিগ্রাম চ্যানেলে ‘মিডল ইস্ট স্পেকটেটর’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রশাসন যা স্পর্শকাতর সময়ে ইরান, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলতে পারে।
নথিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ইরানের ১ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলের সম্ভাব্য আক্রমণের পরিকল্পনা। নথিতে ইসরায়েলের সামরিক প্রস্তুতির বর্ণনা রয়েছে, যা মূলত দেশটির অস্ত্র মোতায়েন এবং আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের মহড়া চালানোর দিকেও ইঙ্গিত করে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব মহড়া ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই পরিচালিত হয়েছে। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সরাসরি এসব নথির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি, ফলে ঘটনার আরও নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ফাঁস হওয়া নথির একাংশে দেখা যায়, এগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে থাকা ‘ন্যাশনাল জিওসপ্যাটিয়াল–ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ এবং ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র তৈরি। এ ধরনের নথিপত্র সাধারণত কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলো বিশেষত ‘ফাইভ আইস’ জোটের সদস্য দেশ—অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য—দেখার সুযোগ পায়। এমন একটি অতিগোপন নথির ফাঁস হওয়া আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ফাঁস মার্কিন-ইসরায়েল কৌশলগত সমন্বয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সিআইএ কর্মকর্তা মাইক মুলরয় বলেন, “ইরানের ১ অক্টোবরের হামলার জবাব নিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা যদি সত্যিই ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে এটি একটি গুরুতর নিরাপত্তা ব্যত্যয়ের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে ভবিষ্যৎ কৌশলগত সমন্বয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করতে পারে।” মুলরয় আরও বলেন, “সম্পর্কের ক্ষেত্রে আস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নথি ফাঁসের কারণে সেই আস্থার ভাঙন ঘটতে পারে।”
তবে এক মার্কিন কর্মকর্তা এ ঘটনাকে “খারাপ নজির” হিসেবে উল্লেখ করলেও তা ‘ভয়ানক’ কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেন, “বড় উদ্বেগের বিষয় হলো এ ধরনের আরও নথি ফাঁস হয় কি না।” নথিগুলো কীভাবে প্রকাশ্যে এলো তা এখনও স্পষ্ট নয়। হ্যাকিং নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস করা হয়েছে সেই বিষয়েও তদন্ত চলছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই ইরানের সাইবার তৎপরতা নিয়ে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে, বিশেষত সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচনে ইরানের হস্তক্ষেপের শঙ্কা বাড়ছে।
গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু, এবং ইরানের ১ অক্টোবরের ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষাপটে এই নথি ফাঁস ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফাঁস হওয়া নথির একাংশে ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্র থাকার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি যদিও এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। তবে নথি ইঙ্গিত করে যে, ইরানের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারেনি। তবুও, ফাঁস হওয়া এসব নথির কারণে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের অবস্থান কিছুটা হলেও বিব্রতকর হতে পারে।
নথি ফাঁসের ঘটনা নিয়ে তদন্তে নেমেছে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (এফবিআই) এবং পেন্টাগন। এফবিআই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও পেন্টাগন ইতোমধ্যেই এই তথ্য ফাঁসের নেপথ্যে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করতে মাঠে নেমেছে।