মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং নিরাপত্তা গত কয়েক দশক ধরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্কের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। আঞ্চলিক নেতৃত্বে আকাঙ্ক্ষা ,তেল রপ্তানি নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের মতো কয়েকটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। দুই দেশের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক বরাবরই বিশ্ব কূটনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে আসছে । কিন্তু অবশেষে এ দুই দেশ তাদের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে ২০২১ ও ২০২২ সালে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতিতে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায়।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান-সৌদি সম্পর্কের পরিবর্তন একটি নতুন বাস্তবতার সূচনা করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
দুই দেশের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-
ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে, যা মূলত ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের জন্য লড়াইয়ের কারণে। ১৯৭৯ সালের ইরানি ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে এই সম্পর্কের জটিলতা বেড়েছে। বিপ্লবের আগে উভয় দেশই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল কিন্তু বিপ্লবের পর ইরানের নতুন শাসনব্যবস্থা সৌদি আরবের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে ওঠে।
কারণ ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরান শিয়া ইসলামের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শিয়াদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়েছে, যা সৌদি আরবের জন্য একটি বিপজ্জনক বিষয়। অপরদিকে সৌদি আরব সুন্নি ইসলামের অভিভাবক এবং পবিত্র মক্কা ও মদিনার রক্ষক হিসেবে হিসেবে ইরানের এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন এবং ইরাকের মতো দেশগুলোতে পরোক্ষভাবে দুই দেশের সংঘাত দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক সম্পর্কের পরিবর্তন-
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা উত্তেজনা এবং সংঘাতপূর্ণ হিসেবেই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ২০১৬ সালে সৌদি আরব ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, যা তাদের মধ্যে শীতল যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করে। ২০১৬ সালে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল শিয়া ধর্মীয় নেতা নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড। ২ জানুয়ারি সৌদি আরব নিমর আল নিমরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, যা ইরান এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এরপর ৬ জানুয়ারি ইরানের তেহরানে সৌদি দূতাবাসে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায় এবং ভবনটি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এই হামলা সৌদি আরবের প্রতি ইরানের ক্ষোভ প্রকাশের একটি চরম দৃষ্টান্ত ছিল। দুই দেশের মধ্যে এই ঘটনার ফলে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংকটে এই উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। এ ধরনের ঘটনা কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে ইরান-সৌদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান এবং সৌদি আরব পুনর্মিলনের এক চুক্তিতে পৌঁছায়। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা হ্রাসের লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়।
চীন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগের এ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। এটি শুধু ইরান-সৌদি সম্পর্কের উন্নতির সুসংবাদের ইঙ্গিত বহন করে তা নয়। বরং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে। এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতমুক্ত পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দুই দেশের সম্পর্কের পরিবর্তনের প্রভাব-
ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কের পরিবর্তন সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের সমাধানে এই সম্পর্ক উন্নয়ন এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এবং ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান সংঘাত কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং পুরো দেশকে ধ্বংস করেছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন, ইয়েমেনের রাজনৈতিক সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবং মানবিক সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সিরিয়া সংঘাতেও ইরান-সৌদি সম্পর্কের পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সিরিয়ায় ইরান বাশার আল-আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে, যেখানে সৌদি আরব বিদ্রোহীদের সমর্থন করে। এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে নতুন আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশটির পুনর্গঠনে সাহায্য করবে।
তৃতীয়ত, লেবাননেও ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাব রয়েছে, যেখানে শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইরানের সমর্থন নিয়ে কাজ করছে। সৌদি আরব হিজবুল্লাহর সাথে তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। তবে, ইরান-সৌদি সম্পর্কের উন্নয়নের ফলে লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমতে পারে এবং দেশটি একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ফিরে আসতে পারে।
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। দুই দেশই বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সহযোগিতা বৈশ্বিক তেলের বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নয়ন তেল উৎপাদনে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তাছাড়া সৌদি আরব এবং ইরান উভয়ই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার চালাচ্ছে। সৌদি আরবের ‘ভিশন ২০৩০’ এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞামুক্ত অর্থনীতি উন্নয়নের প্রচেষ্টা এই দুই দেশকে আরও অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া-
ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ও গভীর প্রভাব ফেলছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় থেকেছে তা হল যুক্তরাষ্ট্র, যাকে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের প্রধান মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় । কেননা দেশটি ইরান-সৌদি পুনর্মিলনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেনি বরং আপাত দৃষ্টিতে দেশটিকে তাদের বন্ধু সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের শত্রু ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনকে ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি বলেই মনে হচ্ছে। চীনের মধ্যস্থতা এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
এদিকে, চীনের এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বাড়ানোর নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী এবং ইরান-সৌদি সম্পর্কের উন্নয়ন এ ক্ষেত্রে চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। কারণ দেশটি অবশ্যই চাইবে না তাকে ছাড়া তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করুক।
বর্তমান পরিস্থিতি-
বর্তমানে দুই দেশই পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সম্প্রতি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহানকে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি সৌদি আরবের জাতীয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান এবং সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠক করেছেন, যেখানে তারা গাজায় চলমান সহিংসতা এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন ।
দুই দেশের সম্পর্কের এই উন্নয়ন মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও প্রসারিত হতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা-
ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। তবে এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে এখনো প্রশ্ন ওঠছে। কারণ দুই দেশের মধ্যে অনেক গভীর শত্রুতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে যা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। বিশেষ করে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য, ধর্মীয় বিরোধ এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপগুলো এই সম্পর্কে আবার উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ইরান-সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সম্পর্কের উন্নয়ন আঞ্চলিক সংঘাতের সমাধান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে। তবে এ সম্পর্কের স্থায়িত্ব এবং আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা সময়ের উপর নির্ভর করবে, কারণ উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চ্যালেঞ্জগুলো এ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবু ও ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার উন্নতিতে দুই দেশের সদিচ্ছা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন কেবল ইয়েমেন, সিরিয়া এবং লেবাননের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর শান্তি প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করতে পারে তাই নয় বরং তেল বাজার এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও স্থিতিশীলতার পথ দেখাতে পারে। একই সঙ্গে, চীনের মধ্যস্থতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাবহীনতা বৈশ্বিক শক্তির পুনর্মূল্যায়নের ইঙ্গিত দেয়। সুতরাং, ইরান-সৌদি সম্পর্কের পরিবর্তনকে শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনা নয় বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যা সমগ্র বিশ্বের জন্য ভালো পরিণতিই বয়ে আনবে বলে আশা করা যায়।