আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসনের অন্ধকার অধ্যায়, গুম-খুনের ঘটনা নিয়ে ৪৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে দেশটির সমুদ্র সৈকতগুলোতে ভেসে আসা এক ডজন বিবস্ত্র ও নির্যাতনের চিহ্নবহুল মরদেহ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেই সময় এসব ঘটনায় কোনো বিচারিক তদন্ত হয়নি। বরং মরদেহগুলোকে গোপনভাবে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে সমাধিস্থ করা হয়।
সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো আড়াল করতে পুলিশ, বিচারক এবং পৌর কর্মকর্তারা একযোগে কাজ করেছিলেন। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে পরিচিত ওই সময়ে অনেক নির্যাতিত ব্যক্তি অপহরণ হয়ে নিখোঁজ হন। তাদের মৃত্যু গোপন রাখার জন্য মরদেহগুলো বিমান থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। ৪৫ বছর পর আর্জেন্টাইন বিচার বিভাগ অবশেষে এই নৃশংসতার বিচার শুরু করেছে, যেখানে অভিযুক্তরা বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
ড্যানিয়েল ইগলেসিয়াস এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য সামনে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে উপকূলে ভেসে আসা প্রায় ২০টি মরদেহের ফাইল তারা খুঁজে পেয়েছেন। তিনি আরও জানান, পুলিশ কখনোই নিহতদের আত্মীয়স্বজনকে মরদেহ শনাক্ত করতে ডেকে নেয়নি। সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়নি এবং বিচারকও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি, যা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েছিল।
এই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ডলোরেস শহরের তৎকালীন তদন্তকারী বিচারক কার্লোস ফাসিও, পুলিশ ডাক্তার মিগেল ক্যাব্রাল এবং বুয়েনোস আইরেস পুলিশের সাতজন সাবেক এজেন্ট ও পৌর কর্মকর্তা। গত সপ্তাহে এ মামলার প্রাথমিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রথম সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্য দেন। মার দেল প্লাটা শহরে এই বিচার কার্যক্রম চলবে এবং আগামী বছরের শুরুতে আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।
আর্জেন্টিনার সামরিক শাসনকাল ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত ছিল। এ সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইতিমধ্যে ১০০০-এর বেশি ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেসময় আর্জেন্টিনায় গোপন বন্দিশিবিরগুলোর চালু হওয়া ছিল স্বৈরশাসনের অন্যতম একটি প্রধান পরিণতি। অপহৃতদের হত্যার জন্য তাদের মাদকাসক্ত করে বিমানে তুলে ফেলা হত এবং এইভাবে অনেকের জীবন সঙ্কটের মুখে পড়েছিল।
সান্তিয়াগো ভিলানুয়েভার ঘটনা একটি উদাহরণ। ১৯৭৮ সালের ২৬ জুলাই তিনি অপহৃত হন। আর তার ১২ বছর বয়সী ছেলে গিলেরমো আজ আদালতে বাবার মৃত্যুর বিচারের জন্য সাক্ষ্য দিচ্ছেন। গিলেরমো জানাচ্ছেন,
“সারাটা জীবন বাবাকে খুঁজেছি। ভাবিনি, কখনও তাকে খুঁজে পাব।”
ভিলা গেসেল কবরস্থানের একটি নোটবুকের সাহায্যে অবশেষে তিনি তার বাবার সমাধিস্থলের সন্ধান পান।
আজকের বিচারকাজ শুধু ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে নয় বরং মানবতার জন্য একটি সংকেত। যে সামরিক শাসনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অপরাধীদের অবশ্যই দণ্ডিত হতে হবে। গিলেরমোর মতো বহু মানুষ আজ তাদের প্রিয়জনের জন্য ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আদালতে উপস্থিত হয়েছেন, যাদের সংগ্রাম পুরো বিশ্বে একটি নতুন বার্তা ছড়াচ্ছে।