গত শুক্রবার এক ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠেছিল জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের ভগ্নাংশের মাঝে। সেখানে বসে ছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। বেশিরভাগই পুরুষ, তাঁদের অনেকেই অর্ধনগ্ন অবস্থায়। ছবিটি তোলা হয়েছিল শিবির ছেড়ে নিরাপদে পালানোর চেষ্টা করা মানুষদের বিভীষিকাময় মুহূর্তে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ইসরায়েলি বাহিনী তাঁদের বাধা দেয়। অর্ধনগ্ন অবস্থায় শীতের মধ্যে বসিয়ে রাখে, যেন সেখানে মানবিকতার কোনো স্থান নেই।
জাবালিয়ার মতো এলাকা, যেখানে মানুষ নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য। সেখানে এই ধরনের অমানবিক আচরণ শুধু প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই করুণ পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সংঘাত কতটা নির্মম হতে পারে।
ছবির মধ্যমণিতে থাকা ছোট্ট মেয়েটি, সাড়ে তিন বছরের জৌরি আবু ওয়ার্দ, তার সাইকেলে চড়েছিল বাবার সঙ্গে নিরাপদে গাজার দিকে রওনা হওয়ার জন্য। কিন্তু পথে ইসরায়েলি সেনাদের তল্লাশিচৌকিতে আটকা পড়ে সে।
জৌরির বাবা মোহাম্মাদ আবু ওয়ার্দ জানান, তাঁকে অন্তর্বাসে রেখে আট ঘণ্টা মেয়ের পাশে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়। তীব্র শীত, তৃষ্ণা ও ক্ষুধার এই মর্মস্পর্শী বাস্তবতা জৌরির মতো শিশুদের জন্য আরও কঠিন। তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্য সন্তান তখন গাজার দিকে যেতে সক্ষম হলেও ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে রাখতে হয়। কিন্তু তখনো তাঁদের জন্য একটুকু পানীয় কিংবা খাবারের আয়োজন ছিল না।
ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক স্থল অভিযান জাবালিয়ায় নতুন করে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তারা দাবি করছে- সেখানে হামাসের পুনর্গঠিত যোদ্ধাদের উপস্থিতি রয়েছে। যার কারণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাই শিবিরের বাসিন্দাদের সরে যেতে বারবার নির্দেশ দেওয়া হলেও সেই পথও ভরে থাকে আতঙ্কে। অভিযোগ রয়েছে, সরাসরি চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে কিছু বাসিন্দার ওপর গুলি চালানো হয়।
এই নির্লজ্জ নগ্নতার শিকার হওয়া শরণার্থীদের একজন মুহাম্মাদ খালাফ সিএনএনকে জানান-
তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে করিডোর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করার সময় ইসরায়েলি সেনারা আটকায়।
খালাফ আরো বলেন-তাঁকে এবং অন্যান্য পুরুষদের শীতের মধ্যে অন্তর্বাসে ফেলে বসিয়ে রাখা হয়, তাঁদের ছবি তোলা হয়, নাম ধরে উপহাস করা হয়। এই মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের শেষ কোথায়, কেউ জানে না। ইসরায়েলি সেনাদের মুখে হাসির আভাস, তবে এই চিত্রে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় স্পষ্ট।
ইসরায়েলি বাহিনী অবশ্য কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে চায়নি এই ছবি নিয়ে। তারা শুধু বলেছে, নিরাপত্তার খাতিরে এই তল্লাশি করা হয়। আইডিএফ-এর ভাষ্যমতে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সন্দেহে আটক করা হয় এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে তাঁদের সঙ্গে আচরণ করা হয়। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের এই বক্তব্য মানতে নারাজ। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, এই নগ্ন তল্লাশি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যা মানুষকে অপমানের মধ্য দিয়ে আরও অসহায় করে তোলে। এই তল্লাশি আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী এবং মানবিকতার প্রতি অবমাননাকর।
জেনেভা কনভেনশনের আওতায় সশস্ত্র সংঘাতে আটক ব্যক্তির প্রতি মানবিক আচরণ করা আবশ্যিক।
ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস বলছে- তল্লাশি একেবারে প্রয়োজন না হলে করা উচিত নয় এবং তা অবশ্যই গোপনীয়তার মধ্যে করতে হবে। ইসরায়েলের এই আচরণ বিশ্বজুড়ে মানবিক মূল্যবোধের ওপর প্রভাব ফেলছে। ছবিতে ধরা পড়া নিষ্ঠুরতা সেই বাস্তবতাই তুলে ধরে, যেখানে বেঁচে থাকার একমাত্র পথই হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানো।
জাবালিয়ার ছবিটি, যেখানে অসহায় মানুষকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় শীতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এটি শুধু একটি ছবি নয় বরং এই সংঘাতের নিষ্ঠুরতার প্রতীক।