ইরান-ইসরাইলের দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এই দ্বন্দ্ব শুধু দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এর প্রভাব পার্শ্ববর্তী সমগ্র অঞ্চল এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও কূটনীতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যে শত্রুতা শুরু হয়েছে, তা মূলত- আদর্শিক, ধর্মীয় ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাতকে কেন্দ্র করে। ইরান ইসরাইলের কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দেয় না এবং ইসরাইলের নীতিমালাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। অন্যদিকে, ইসরাইল ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব ও সামরিক ক্ষমতাকে হুমকি হিসেবে দেখে এবং নিজেকে ইরানের বলয় থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। এই দ্বন্দ্ব কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। এই দ্বন্দ্ব কখনোই পুরোপুরি সমাধান হয়নি বরং সময়ের সাথে সাথে আরও জটিল ও তীব্র হয়ে উঠেছে।
ইরান ও ইসরাইলের সম্পর্ককে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যেমন -১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক সময়কাল; ১৯৫৩ থেকে ১৯ ৭৯ সাল পর্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সময়কাল; ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অবনতিশীল সময়কাল এবং ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে প্রকাশ্য শত্রুতা। তারপর থেকে তাদের মধ্যে একের পর এক শত্রুতা চলছে। যা এখন চরম শত্রুতার মতো সম্পর্কে রূপ নিয়েছে।
ইরান – ইসরাইলের দ্বন্দ্বের জের:
ইরান ইসরাইলের দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড অন্যায় ভাবে দখল করে গঠিত হওয়া ইসরাইলের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি, আরব বিশ্বের প্রতি সমর্থন, পারমাণবিক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পার্থক্য, ভৌগলিক প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত, প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই ইত্যাদি।
ইরান- ইসরাইলের দ্বন্দ্বের সূচনা ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে হয়। এই বিপ্লবের আগে ইরান ছিল ইসরাইলের একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র। কারণ, তৎকালীন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি একটি পশ্চিমা ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ইরান পশ্চিমা শক্তি এবং বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। যারা ইসরাইলকেও সহযোগিতা করত। তবে, ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান সম্পূর্ণভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি কঠোর অবস্থান নেয়। ইরানের নতুন নেতৃত্ব ইসরাইলকে একটি “অবৈধ রাষ্ট্র” হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ইসরাইলের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে।
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দ্বন্দ্বের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো-
আদর্শিক পার্থক্য: ইরান একটি ইসলামি রাষ্ট্র যা ইসলামের আদর্শকে প্রাধান্য দেয়, যেখানে ইসরাইল একটি ইহুদি রাষ্ট্র। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ইসরাইলকে একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখে এবং তাদের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইসরাইল বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা তাদের কৌশলের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ:
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াইও ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করেছে। ইরান তার পরিকল্পনা ও কৌশল মতো তার আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করে এবং এতে ইসরাইলকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। ইসরাইল আবার ইরানের প্রভাবকে তার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করে। বিশেষত: ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরাইলের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বন্দ্বের ক্রম বিকাশ: ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্ব সময়ের সাথে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে হিজবুল্লাহর উত্থান এই দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করেছে। ইরান হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মতো বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক ও কৌশলগত অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ইসরাইল ও তার মিত্ররা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে। ইরান বরাবরই দাবি করেছে যে, তার পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। তবে ইসরাইল এবং পশ্চিমা দেশগুলো একে সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছে। ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর উপর সামরিক হামলার হুমকি দিয়েছে এবং বেশ কয়েকবার গোপন অভিযানের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমান সময়ে ইরান- ইসরাইল সম্পর্ক আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইয়েমেন সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকা ইসরাইলকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ইরানের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিশেষত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক মিত্রদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করার কৌশল, আগ্রাসী ইসরাইলকে প্রতিনিয়ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে বাধ্য করছে ,যা একটি উত্তম দিক।
বর্তমান সময়ে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ২০২৪ সালে ইরান – ইসরাইলের সংঘাত দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষে পরিণত হয়। এ বছর পহেলা এপ্রিল ইসরায়েল, সিরিয়ার দামেস্কে একটি ইরানি দূতাবাস ভবনে বোমা হামলা করে, তাতে একাধিক জ্যৈষ্ঠ ইরানি কর্মকর্তা নিহত হয়। এরই প্রতিক্রিয়ায়, ইরান ১৩ই এপ্রিল ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ এপ্রিল ইরানে প্রতিশোধ মূলক হামলা চালায় ইসরাইল। সাম্প্রতিক সামরিক হামলা ও পাল্টা হামলার ফলে তাদের সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে, ইসরাইল ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা এবং পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোর উপর হামলা চালিয়েছে। ইরানও এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিত্রদের মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে ইসরাইলের উপর চাপ বাড়িয়েছে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের অবস্থান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরান সবসময় ন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করেছে এবং ইসরাইলের ফিলিস্তিন নীতি ও সামরিক পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে আসছে। বিশেষত: গাজায় ইসরাইলি অন্যায় সামরিক অভিযান এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের বিষয়ে ইরান কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ইসরাইলের ফিলিস্তিন নীতির কারণে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
বর্তমানে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও উভয় পক্ষই সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ছায়া যুদ্ধ এবং পরোক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে আছে। ইরান তার আঞ্চলিক মিত্রদের মাধ্যমে ইসরাইলকে ঘিরে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে। যেখানে ইসরাইল আঞ্চলিক , সামরিক ও কৌশলগত অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে ইরানের হুমকি মোকাবিলা করছে।
এ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নির্ভর করবে এই দ্বন্দ্বের কূটনৈতিক সমাধানের ওপর। তবে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আরও অস্থিতিশীলতা বয়ে আনতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ইরান-ইসরাইলের দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত গুলির মধ্যে একটি। যা কেবল আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক স্থিতি শীলতাকেও প্রভাবিত করছে। এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে আদর্শিক, ধর্মীয় এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাতের কারণে এখনো কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি। ভবিষ্যতে এই দ্বন্দ্বের গতিপথ নির্ভর করবে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলের ওপর।