মধ্যপ্রাচ্য একটি ভূরাজনৈতিক সংকটপূর্ণ অঞ্চল। যা বৃহত্তম তেল ও গ্যাসের উৎপাদক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কেন্দ্র এবং ঐতিহাসিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের সংঘাতের পেছনে একাধিক শক্তিধর আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, যা পরিস্থিতির জটিলতা এবং গভীরতা বৃদ্ধি করেছে। এই সংঘাতগুলো সাধারণত কৌশলগত স্বার্থ, সম্পদ বিতরণ, ধর্মীয় বিরোধ এবং জাতিগত উত্তেজনার সাথে জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের পেছনে সক্রিয় শক্তিধর জোটগুলোর ভূমিকা:
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের পেছনে সক্রিয় শক্তিধর জোটগুলোর ভূমিকা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অঞ্চলটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থার প্রভাব অত্যন্ত জটিল ও বহুমুখী। নিচে বিভিন্ন শক্তি ও জোটের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:
আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা:
১. যুক্তরাষ্ট্র – মধ্যপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী দেশগুলোর নামের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নামই প্রথমে চলে আসে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অভিযান অঞ্চলটিতে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। ইরাক যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শূন্যতা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এবং পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একদিকে ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়েছে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে।
২. রাশিয়া – রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সিরিয়াতে তার সামরিক উপস্থিতি। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে সমর্থন দিয়ে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সিরিয়ার সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে এবং এটি ইরানের সাথে তার সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে। রাশিয়ার ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সংকট যেমন- লিবিয়া ও ইরাকে প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়া অস্ত্র সরবরাহ ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করে এ অঞ্চলটিতে প্রভাব বিস্তার করেছে ।
৩. ইউরোপীয় ইউনিয়ন : ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক চুক্তি (জে সি পি ও এ) সমর্থন করে এবং সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করে। তবে, তাদের সীমিত সামরিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা সংঘাত নিরসনে তুলনামূলকভাবে কম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে এবং উন্নয়ন সহায়তা দেয় কিন্তু তাদের প্রভাব সীমিত।
আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকা:
ইরান: ইরান মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী প্রথম দেশ। ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথি বাহিনীর মতো গোষ্ঠীগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়িয়েছে।
ইরান, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে বিভিন্ন সামরিক গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।
এমনকি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যা প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তারা একটি শিয়া প্রধান দেশ হিসেবে সৌদি আরবের মতো সুন্নি প্রধান দেশগুলোর সাথে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় জড়িত । ইরানের তেল ও গ্যাসের মজুত মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তারকারী। ইরান প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে এর সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনকে সমর্থন করে ইরান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে। দেশটি ইরাকের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। শিয়া দলগুলোকে সমর্থন দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখছে। আবার হরমুজ প্রণালীতে তারা উপস্থিতি শক্তিশালী করে বৈশ্বিক তেলের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা তুরস্ক এবং রাশিয়ার মতো শক্তির সাথে মিত্রতা তৈরি করে আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থান মজবুত করেছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। সৌদি আরবের সাথে ইরানের প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে তারা নানা ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের কলকাঠি নাড়াতে ভূমিকা রাখে।
সৌদি আরব: সৌদি আরব সুন্নি ইসলামের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা এবং ইরানের শিয়া প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। ইয়েমেনের সংকটে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপ ও সিরিয়ায় সৌদি আরবের ভূমিকা এই অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে শিয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে তার অবস্থান এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করেছে। সৌদি আরবের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর উপর সৌদি আরবের প্রভাব নির্ধারণ করে।
তুরস্ক: তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার করছে। সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং কুর্দি গোষ্ঠীর প্রতি তার অবস্থান অঞ্চলটিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের নীতি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে কুর্দি মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের সামরিক অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের একটি উল্লেখযোগ্য ইস্যু।
কাতার: কাতার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আল-জাজিরার মাধ্যমে কাতার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। কাতার বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সমর্থন প্রদান করে যেমন: মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠী, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে প্রভাব ফেলেছে। আবার সম্প্রতি ফিলিস্তিনের যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করা নিয়ে তাদের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য।
ইসরায়েল: ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত অঞ্চলটির নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও তার নিরাপত্তা কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে। ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের ফলে অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে।
আঞ্চলিক গোষ্ঠী:
হিজবুল্লাহ: প্রথম হিজবুল্লাহ আলোচনায় আসে লেবাননে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং সারা অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। তারা লেবাননের সরকারে অংশগ্রহণ করে এবং পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে। হিজবুল্লাহ ইরান থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা গ্রহণ করে তার সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে। এই সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে তীব্র করে অঞ্চলটিতে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।
হুতি: এই গোষ্ঠীটি ইয়েমেনের সরকারকে উৎখাত করে
নিজস্ব রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে আঞ্চলিক সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেছে, যা ইয়েমেনের মানবিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।
এছাড়া এই গোষ্ঠীটি সৌদি আরব এবং তার মিত্রদের সাথে সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়ে ইয়েমেনের সংকটকে আরও বৃদ্ধি করেছে। এই দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও রাজনীতি জটিল করে তোলেছে। ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ থাকলেও সরাসরি সামরিক সহায়তার প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এই দুই গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, যার ফলে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রভাবিত করে।
পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একটি কার্যকর কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা। জাতিসংঘ, আরব লীগ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কূটনৈতিক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অংশগ্রহণ শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আঞ্চলিক উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করা। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করবে। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান জানানো এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপকে উৎসাহিত করা সংঘাত মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া উন্নয়ন করে রাজনৈতিক সংঘাত কমানো সম্ভব।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের জটিলতা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সক্রিয় ভূমিকার ফলস্বরূপ। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। যার মধ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বোঝাপাড়ার মতো বিষয়গুলো জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহায়ক পদক্ষেপের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে।