মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে জর্ডান একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আরব বিশ্বের একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে জর্ডান দীর্ঘদিন ধরে আরব ঐক্য এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখে এসেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ইসরাইলের সাথে জর্ডানের সম্পর্ক এবং তাদের পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জর্ডানের ইসরাইলি স্বার্থে সমর্থন কি আরব ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা – নাকি এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গভীরভাবে জর্ডানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নীতি বিশ্লেষণ করা জরুরী।
জর্ডানের আরব ঐক্যের ইতিহাস:
জর্ডানের রাজনৈতিক অবস্থান সবসময়ই আরব ঐক্যের সাথে জড়িত ছিল। ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে জর্ডানের শক্তিশালী সমর্থন এবং ইসরাইল বিরোধী অবস্থান এদেশটিকে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছেও সম্মানিত করে তুলেছিল। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের পর, ইসরাইল পশ্চিমতীর দখল করে, যা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। জর্ডান তখন ফিলিস্তিনের একটি বড় অংশের জনগণকে আশ্রয় দিয়ে পাশাপাশি তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা বলে তাদের সমর্থন বজায় রেখেছিলো।
তবে, ইসরাইলের সাথে জর্ডানের সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ওয়াদি আরাবা চুক্তির মাধ্যমে- জর্ডান আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, যা আরব বিশ্বের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে। এই চুক্তির মাধ্যমে জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। জর্ডানের জন্য এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তিতে তারা নিজেদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যকে এ চুক্তির অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছিল।
কি এই ওয়াদি আরাবা চুক্তি:
ওয়াদি আরাবা চুক্তি – ২৬ অক্টোবর ১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। যা দীর্ঘদিনের গোপন আলোচনার পর দুই দেশের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি হিসেবে কাজ করে। এই চুক্তির মাধ্যমে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা যুদ্ধাবস্থা শেষ হয় এবং জর্ডান- ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর মধ্যে ছিল সীমানা নির্ধারণ, পানি ভাগাভাগি এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়ে সহযোগিতা। এছাড়াও, এই চুক্তি জর্ডানকে আল- আকসা মসজিদসহ জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ওয়াদি আরাবা চুক্তির পরিণতি হিসেবে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার যুগ শুরু হয়। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা তাদের মধ্যে সুরক্ষা পাশাপাশি বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। সীমানা নির্ধারণ ও পানির ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা, উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সহায়ক হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও পর্যটন সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। এছাড়া এই চুক্তি নিরাপত্তা ও সীমান্ত বিরোধের ক্ষেত্রেও একটি সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে।
জর্ডানের ইসরাইলকে সমর্থনের অজুহাত:
সম্প্রতি ২০২৪ সালের ১৩ ই এপ্রিল, ইরান যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি মিসাইল আক্রমণ চালায়, তখন জর্ডান সক্রিয়ভাবে ইসরাইলের সমর্থনে এগিয়ে আসে। ইরানি মিসাইল গুলো ইসরাইলের দিকে অগ্রসর হলে, জর্ডান তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে আক্রমণের প্রতিরোধে সহায়তা করে। জর্ডানের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা ও কূটনৈতিক চাপ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের আক্রমণের তীব্রতা কমাতে সহায়ক হয়। এছাড়াও জর্ডান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইরানের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে সহায়তা প্রদান করে। এই ঘটনার মাধ্যমে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও সু-দৃঢ় হয় এবং দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা একটি নতুন মাত্রা লাভ করে।
মূলত: জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ইসরায়েলপন্থি হিসেবেই পরিচিত। তার নেতৃত্বেই জর্ডান প্রথম আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বদলে ইসরাইলপন্থী নীতি গ্রহণ করে । জর্ডান ইসরাইলের সাথে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা কিছু আরব দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে। তিনি ১৯৯৪ সালের ওয়াদি আরাবা চুক্তি স্বাক্ষরিত করে ইসরাইলের সাথে শান্তি ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করেন। যা আরব ঐক্যের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিং আবদুল্লাহ দ্বিতীয়ের শাসনামলে, জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং পানি সংক্রান্ত চুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন, যা অনেক আরব দেশের সমালোচনা ও বিরোধের মুখে পড়েছে। এই সহযোগিতা জর্ডানের আরব ঐক্যের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়। যা ইসরাইলের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জর্ডানের ইসরাইলি স্বার্থে সমর্থনের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। প্রথমত: জর্ডান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে প্রথম অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছে । ইরান এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি ও শত্রুর হুমকি মোকাবিলায় ইসরাইলের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব জর্ডানের জন্য কাম্য ছিল। দ্বিতীয়ত: জর্ডানের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল করতে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, জর্ডানের পানি সংকট মোকাবিলায় ইসরাইলের সাথে সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বিশ্বাসঘাতকতা নাকি কৌশল?
জর্ডানের ইসরাইলি স্বার্থে সমর্থনকে অনেকেই আরব ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছেন। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি অবহেলা এবং ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখাকে সমালোচকরা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তাদের মতে, জর্ডান আরব ঐক্যের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করছে।
অন্যদিকে, জর্ডানের কৌশলগত অবস্থানকে সমর্থনকারী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি বাস্তববাদী এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে জর্ডান নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই পদক্ষেপগুলি নিচ্ছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে, জর্ডান তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, যা একদিক থেকে কৌশলগতভাবে সঠিক।
জর্ডানের এই পদক্ষেপগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে জর্ডানের অবস্থান পরিবর্তন এবং ইসরাইলের সাথে তাদের সহযোগিতা আরব বিশ্বের অভ্যন্তরে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। জর্ডান এ জন্য একটি কঠিন সময়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। যেখানে তাদেরকে আঞ্চলিক সমীকরণ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
জর্ডানের ইসরাইলি স্বার্থে সমর্থন নিয়ে আরব বিশ্বে মতভেদ বিদ্যমান। এটি কি আরব ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, নাকি কৌশলগত পদক্ষেপ? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে জর্ডানের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাদের নিরাপত্তা চাহিদা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। জর্ডান যদি সফলভাবে তাদের স্বার্থরক্ষা করতে পারে পাশাপাশি একই সাথে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তবে, এই কৌশলটি সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদে সঠিক প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে, যদি আরব ঐক্যকে দুর্বল করে ফেলে তাহলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকটের জন্ম দিতে পারে।